কুরআন-হাদীসের আরবি দলিলসহ বিস্তারিত বর্ণনা ও ৫০টি বহুল আলোচিত প্রশ্নোত্তর
অজু করার সহীহ পদ্ধতি, ফজিলত, গুরুত্ব, দোআ ও আমল

- আপডেট সময়ঃ ১১:৩৪:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫
- / ৩৫ বার পড়া হয়েছে।

অজু করার সহীহ পদ্ধতি, ফজিলত, গুরুত্ব, দোআ ও আমল — কুরআন-হাদীসের আরবি দলিলসহ বিস্তারিত বর্ণনা ও ৫০টি বহুল আলোচিত প্রশ্নোত্তর
অজুর সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
অজু (الوضوء) ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম। এটি নামাজসহ অনেক ইবাদতের পূর্বশর্ত। কুরআন ও হাদীসে অজুর গুরুত্ব অনেকবার বর্ণিত হয়েছে।
কুরআনের দলিল:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের জন্য প্রস্তুত হও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো, মাথা মাসাহ করো এবং পা গিরা পর্যন্ত ধৌত করো।”
📖 (সূরা আল-মায়িদাহ: ৬)
হাদীসের দলিল:
“الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ”
“পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ।”
📖 (সহীহ মুসলিম: ২২৩)
অজুর সহীহ (সঠিক) পদ্ধতি
১. নিয়ত করা (নিয়্যাহ): অন্তরে অজুর উদ্দেশ্যে নিয়ত করা।
২. বিসমিল্লাহ বলা: অজু শুরুর আগে “বিসমিল্লাহ” বলা সুন্নত।
৩. হাত ধোয়া (৩ বার): কব্জি পর্যন্ত।
৪. কুলি করা (৩ বার): মুখে পানি ঢেলে কুলি করা।
৫. নাকে পানি নেওয়া (৩ বার): নাকে পানি নিয়ে পরিষ্কার করা।
6. মুখ ধোয়া (৩ বার): থুতনি থেকে কপাল পর্যন্ত।
7. হাত ধোয়া (৩ বার): কনুই পর্যন্ত।
8. মাথা মাসাহ (১ বার): মাথার সামনের দিক থেকে পেছনে এবং আবার সামনে মাসাহ করা।
9. কান মাসাহ: একবার।
10. পা ধোয়া (৩ বার): গোড়ালি পর্যন্ত।
দোআ
অজুর পরে এই দোআ পড়া রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত:
“أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ. اللّهُمَّ اجْعَلْنِيْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ، وَاجْعَلْنِيْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ”
📖 (তিরমিযী: ৫৫)
অজুর ফজিলত ও পুরস্কার
- গুনাহ মাফ:
“যে ব্যক্তি অজু করে, তার অজুর সময় গোনাহসমূহ ঝরে পড়ে যায়।”
📖 (সহীহ মুসলিম: ২৪৪) - জান্নাতে প্রবেশ:
“যে ব্যক্তি পূর্ণরূপে অজু করে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত।”
📖 (বুখারী: ১৫৮)
৫০টি বহুল আলোচিত অজানা প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. অজু ছাড়া নামাজ হলে কি নামাজ হবে?
না, অজু ছাড়া নামাজ সহিহ হবে না। (সূরা আল-মায়িদাহ: ৬)
২. ঘুমালে কি অজু ভেঙে যায়?
হ্যাঁ, গভীর ঘুমে গেলে অজু ভেঙে যায়। (তিরমিযী: ৭৬)
৩. পায়খানা থেকে এসে অজু লাগবে?
হ্যাঁ, অজু ভেঙে যাবে। (বুখারী: ১৩৫)
৪. নারীর স্পর্শে অজু ভাঙ্গে?
ইমামদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী মতে ভেঙে যায়, হানাফী মতে নয়।
৫. অজু না করে কুরআন পড়া যাবে?
মুখে তিলাওয়াত করা যাবে, কিন্তু স্পর্শ করার জন্য ওযু আবশ্যক। (সূরা আল-ওয়াকিয়া: ৭৯)
৬. পা মোজা পরে মাসাহ করা যাবে?
যদি মোজা মাসাহের উপযুক্ত হয় তবে হ্যাঁ। (মুসলিম: ২৭৪)
৭. ওজুর সময় কোন দিক থেকে ধোয়া শুরু করতে হবে?
ডান দিক থেকে শুরু করা সুন্নত। (বুখারী: ১৬৪)
৮. একবার ধুলেই কি হবে?
হ্যাঁ, একবারে ফরয আদায় হয়; তবে তিনবার সুন্নত।
৯. পানি না থাকলে কি করতে হবে?
তায়াম্মুম করতে হবে। (সূরা নিসা: ৪৩)
১০. তায়াম্মুমের নিয়ম কী?
পরিষ্কার মাটি ছুঁয়ে মুখ ও হাত মাসাহ করতে হবে। (সূরা নিসা: ৪৩)
…
(👉 এইভাবে বাকী ৪০টি প্রশ্নও ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হবে, যেমনঃ)
- অজুর সময় দোআ পড়া যাবে কি?
- ভুলে গেলে কী করতে হবে?
- অজু করে কি প্রতিটি নামাজের জন্য পুনরায় করতে হবে?
- কিভাবে শিশুকে অজুর অভ্যাস শেখানো যাবে?
- অজুর আগে মিসওয়াক করা কি জরুরি?
১১. অজু ছাড়া কি নামাজ আদায় করা যায়?
না, নামাজের জন্য অজু আবশ্যক।
📖 القرآن:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ…
(সূরা মায়িদাহ: ৬)
১২. অজুর শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা কি জরুরি?
হ্যাঁ, সুন্নত এবং এতে বরকত হয়।
📖 الحديث:
لاَ وُضُوءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرِ اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ
(আবু দাউদ: ১০১)
১৩. ওজুর সময় কি কি সুন্নত আমল আছে?
-
মিসওয়াক করা
-
তিনবার ধোয়া
-
ডান দিক আগে
-
অজুর দোয়া পড়া
(তিরমিযি: ৩৯)
১৪. অজুর পর যে দোয়াটি পড়া উত্তম তা কী?
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
📖 (মুসলিম: ২৩৪)
১৫. অজুর ফরজ কতটি ও কী কী?
চারটি:
১. মুখ ধোয়া
২. হাত কনুইসহ ধোয়া
৩. মাথা মাসাহ
৪. পা টাখনুসহ ধোয়া
📖 (সূরা মায়িদাহ: ৬)
১৬. ঘুমালে অজু ভেঙ্গে যায় কি?
হ্যাঁ, যদি ঘুম গভীর হয়।
📖 (আবু দাউদ: ২০৩)
১৭. অজুর সময় কথা বলা নিষেধ?
না, একেবারে হারাম নয়, তবে ইবাদতের সময় কথা না বলা উত্তম।
১৮. মাথা মাসাহ কতটুকু করলে যথেষ্ট হবে?
পুরো মাথায় একবার মাসাহ করাই সুন্নত।
📖 (বুখারী: ১৮৫)
১৯. অজু করে কি গুনাহ মাফ হয়?
হ্যাঁ, হাদীসে এসেছে অজুর মাধ্যমে গুনাহ ঝরে পড়ে।
📖 (মুসলিম: ২২৯)
২০. অজুর পর দুই রাকাত নামাজ পড়ার ফজিলত কী?
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে, যাতে মনোযোগ থাকে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।”
📖 (বুখারী: ১৫৯
২১. মুখ ধোয়ার সময় দাড়ি ধোয়ার নিয়ম কী?
যাদের দাড়ি ঘন, তাদের উপর দাড়ির বাইরের অংশ ধোয়া ফরজ। পাতলা দাড়ি হলে ভেতরেও পানি পৌঁছানো আবশ্যক।
📖 (তিরমিযি: ২৮৭)
২২. অজুর সময় বাম দিক থেকে ধোয়া যাবে?
হ্যাঁ, তবে ডান দিক থেকে শুরু করা সুন্নত এবং উত্তম।
📖 (বুখারী: ১৬৮)
২৩. অজুর সময় কথা বলা যাবে কি?
অজুর সময় দুনিয়াবী কথা না বলা উত্তম। ইবাদতের মধ্যে মনোযোগ রাখা উচিত।
২৪. অজুর সময় মুখে দোআ পড়া কি প্রমাণিত?
না, অজুর প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় নির্দিষ্ট দোআ নেই। শেষে একটি দোআ আছে যা হাদীসে প্রমাণিত।
২৫. কি কি কারণে অজু ভেঙে যায়?
পায়খানা-পেশাব, গ্যাস নির্গমন, ঘুম, পাগল হওয়া, জ্ঞান হারানো ইত্যাদি।
📖 (বুখারী: ১৩৭)
২৬. অজু ছাড়া তওয়াফ করা যাবে?
না, কাবা শরীফের তওয়াফ করতে হলে অজু আবশ্যক।
📖 (তিরমিযী: ৯৬১)
২৭. মৃত ব্যক্তির অজু করানো কি আবশ্যক?
না, মৃতের গোসল দেওয়া হয়; আলাদা করে অজু করানো হয় না।
২৮. রক্ত বের হলে অজু ভাঙবে কি?
ইমামদের মাঝে মতভেদ আছে। হানাফি মতে ভাঙে, অন্যদের মতে নয়।
২৯. কান মাসাহ না করলে কি অজু হবে?
হবে, কারণ এটি সুন্নত। তবে মাসাহ করা উত্তম।
৩০. নখের নিচে ময়লা থাকলে অজু সহিহ হবে কি?
না, যদি পানি নিচে না পৌঁছে তবে অজু সহিহ হবে না।
৩১. ওজুর সময় হাতের চুড়ি বা আংটি খোলা লাগবে?
যদি পানি চামড়ায় পৌঁছায় না, তবে খুলে ধোয়া আবশ্যক।
৩২. অজুতে উল্টো ক্রমে ধোয়া হলে হবে কি?
না, ফরজ অঙ্গসমূহ ধারাবাহিকভাবে ধোয়া জরুরি।
📖 (সূরা মায়িদাহ: ৬)
৩৩. এক অজু দিয়ে কি দুই নামাজ পড়া যাবে?
হ্যাঁ, যদি অজু না ভাঙ্গে।
৩৪. সূরা পড়ার সময় কি অজু দরকার?
না, মুখে পড়তে অজু না থাকলেও চলবে। কিন্তু কুরআন স্পর্শ করলে ওজু আবশ্যক।
📖 (সূরা আল-ওয়াকিয়া: ৭৯)
৩৫. শুধু পানি ছিটানো কি অজু হবে?
না, প্রতিটি অঙ্গ ঠিকভাবে ধোয়া জরুরি।
৩৬. কি পরিমাণ পানি অজুর জন্য উত্তম?
রাসূল ﷺ এক মুদ পানি ব্যবহার করতেন (প্রায় ৬২৫ মি.লি.)
📖 (বুখারী: ২০১)
৩৭. ওজুর পর কাপড় বদলানো লাগবে কি?
না, যদি কাপড়ে নাপাক কিছু না থাকে।
৩৮. কেউ যদি অজুর ভুল করে, তবে কী করতে হবে?
ফরজ অংশ বাদ পড়লে পুরো অজু পুনরায় করতে হবে।
৩৯. ঠান্ডার কারণে অজু না করে তায়াম্মুম করা যাবে?
যদি পানি ব্যবহার করলে ক্ষতি হয়, তবে হ্যাঁ।
📖 (সূরা নিসা: ৪৩)
৪০. এক হাত দিয়ে অজু করা যাবে?
হ্যাঁ, তবে যতটা সম্ভব দুই হাত ব্যবহার করা উত্তম।
৪১. অজুর আগে নখ কাটা যাবে কি?
হ্যাঁ, এতে সমস্যা নেই।
৪২. নারীরা কি নখে নেইলপলিশ থাকলে অজু করতে পারবে?
না, পানি নখে না পৌঁছালে অজু সহিহ হবে না।
৪৩. অজুর সময় কেউ সাহায্য করলে সমস্যা আছে কি?
না, প্রয়োজনে সাহায্য নেওয়া যায়।
৪৪. দাঁত ব্রাশ করলে কি কুলি করতে হবে?
হ্যাঁ, কুলি করাও সুন্নত।
৪৫. চোখে লেন্স থাকলে অজু হবে কি?
হ্যাঁ, চোখ ধোয়া ফরজ নয়।
৪৬. অজুর দোআ না পড়লে কি কিছু হবে?
না, এটি সুন্নত। না পড়লে গুনাহ নেই, তবে সওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে।
৪৭. মোবাইল স্পর্শ করতে কি অজু লাগবে?
না, মোবাইলে কুরআন স্পর্শ করলেও ওজু আবশ্যক নয়।
৪৮. বাচ্চাদের কিভাবে অজু শেখাবো?
নিজে করে দেখিয়ে শেখাতে হবে। ধীরে ধীরে অভ্যাস করাতে হবে।
৪৯. ওজুর সময় পানি অপচয় হলে গুনাহ হবে?
হ্যাঁ, রাসূল ﷺ পানির অপচয় নিষেধ করেছেন।
📖 (ইবন মাজাহ: ৪২৫)
৫০. ওজু করলে রোগ প্রতিরোধ হয় কি?
হ্যাঁ, হাদীস ও আধুনিক বিজ্ঞান বলে ওজু স্বাস্থ্য রক্ষায় উপকারী।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সহীহ অজু করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
🤲 اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَّوَّابِينَ، وَاجْعَلْنِي مِنَ الْمُتَطَهِّرِينَ
অজু শুধু নামাজের পূর্বশর্ত নয়, এটি ইসলামী জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একজন মু’মিনের প্রতিদিনকার জীবনে অজুর গুরুত্ব অপরিসীম। অজু মানুষকে বাহ্যিক ও আত্মিকভাবে পরিচ্ছন্ন রাখে। আমাদের উচিত প্রতিদিন সঠিক নিয়মে অজু করা এবং এর ফজিলত লাভ করা।
FAQs (সংক্ষিপ্তভাবে)
১. অজুর কতটি ফরয?
চারটি: মুখ ধোয়া, হাত ধোয়া, মাথা মাসাহ, পা ধোয়া।
২. একবার অজু করলে কয়টি নামাজ পড়া যাবে?
যতক্ষণ না ভাঙ্গে ততক্ষণ সব নামাজ আদায় করা যাবে।
৩. কানে পানি ঢোকানো কি জরুরি?
না, মাসাহ করতে হবে; পানি ঢোকানো নয়।
৪. মহিলাদের জন্য অজুতে ভিন্ন নিয়ম আছে কি?
না, নিয়ম একই, তবে সতর্কতা বেশি জরুরি।
৫. তায়াম্মুম কি শুধু নামাজের জন্য?
না, যেকোন ইবাদতের জন্য প্রযোজ্য যেখানে অজু জরুরি।