রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ মেনে চলা
ইসলামে কালো জাদু (ব্ল্যাক ম্যাজিক) হারাম কেন?

- আপডেট সময়ঃ ১১:৪২:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
- / ৪২ বার পড়া হয়েছে।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের প্রসারে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলেও, এখনো অনেক মানুষ কালো জাদু বা ব্ল্যাক ম্যাজিকের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। ইসলামে এ বিষয়ে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু কেন এই জাদু ইসলাম ধর্মে হারাম ঘোষিত? চলুন কুরআন ও হাদীসের আলোকে বিস্তারিতভাবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করি।
কালো জাদু (Sihr) কী?
ইসলামে ‘সিহর’ বা কালো জাদু হলো এমন একটি কার্যক্রম যা জ্বিন বা শয়তানের সহায়তায় মানুষের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এটি মানুষের মন, দেহ বা সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
“তারা এমন কিছু অনুসরণ করে যা শয়তানরা সুলায়মানের রাজত্বে পড়ত। অথচ সুলায়মান কুফরি করেনি বরং শয়তানরাই মানুষকে যাদু শিখিয়ে কুফরি করেছিল।”
— (সূরা আল-বাকারা, ২:১০২)
কালো জাদুর প্রকারভেদ
কালো জাদুর বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যেমন:
-
দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো
-
কাউকে মানসিক বা শারীরিকভাবে অসুস্থ করে তোলা
-
প্রেমে বশ করা বা প্রেমে বাধা সৃষ্টি করা
-
অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করা
প্রত্যেকটি কার্যক্রমই মানুষের মধ্যে বিভেদ, ক্ষতি এবং অনৈতিকতা সৃষ্টি করে।
হারুত ও মারুতের ঘটনা (সূরা বাকারা)
আল্লাহ তায়ালা বানু ইসরাইলের মাঝে দুই ফেরেশতা পাঠান — হারুত ও মারুত। তারা জাদু শিক্ষা দিত, কিন্তু আগে সতর্ক করত:
“আমরা তো কেবল পরীক্ষা স্বরূপ পাঠানো হয়েছি, কাজেই তুমি কুফরি করো না।”
— (সূরা বাকারা, ২:১০২)
কিন্তু মানুষ এই সতর্কতা না মেনে জাদু শিখে ফেলে।
ইসলামে কালো জাদু কেন হারাম?
১. এটি শিরক (অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ)
কালো জাদুর অনেক প্রক্রিয়ায় জ্বিন বা শয়তানের সাহায্য চাওয়া হয়, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর প্রতি ভরসা ও উপাসনা হিসেবে পরিগণিত হয়। এটি সরাসরি শিরক।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে শরিক করে।”
— (সূরা আন-নিসা, ৪:৪৮)
২. সমাজে বিভ্রান্তি ও ক্ষতির কারণ
জাদু পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, এমনকি কাউকে মেরে ফেলতেও পারে।
“তারা এমন কিছু শিখে, যা দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়।”
— (সূরা আল-বাকারা, ২:১০২)
৩. সাতটি মহাপাপের অন্যতম
রাসূল ﷺ বলেন:
“সাতটি ধ্বংসকারী গুনাহ থেকে দূরে থাকো।… এর মধ্যে একটি হলো যাদু করা।”
— (সহীহ বুখারী, মুসলিম)
কিভাবে কালো জাদু করা হয়?
ব্ল্যাক ম্যাজিকের ক্ষেত্রে সাধারণত নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
-
কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে পাঠ করা
-
রক্ত, মৃত প্রাণীর অংশ বা বিশেষ তাবিজ ব্যবহার
-
শয়তানের নামে বলি দেওয়া
-
নাম বা ছবির মাধ্যমে জাদু প্রয়োগ করা
জ্বিন ও শয়তানের সহায়তা নেয়া
জাদুকররা সাধারণত জ্বিন বা শয়তানের সাথে চুক্তি করে। এর বিনিময়ে তারা ইসলামের পবিত্রতা লঙ্ঘন করে, যেমন:
-
কুরআন শরীফের পাতা পদদলিত করা
-
শয়তানের নামে দুঃশ্চিন্তা বা বলি দেওয়া
এগুলো কুফরি কাজ এবং ইমান হারানোর পথে নিয়ে যায়।
জাদুকরের কাছে যাওয়া হারাম কেন?
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“যে ব্যক্তি কোন জ্যোতিষীর কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মদের উপর যা নাজিল হয়েছে, তা অস্বীকার করল।”
— (আবু দাউদ, হাদীস ৩৯০৪)
কালো জাদুর পরিণতি
দুনিয়াতে:
-
মানসিক অস্থিরতা, ভয়, বিভ্রান্তি
-
সংসার ধ্বংস
-
শারীরিক অসুস্থতা
আখিরাতে:
-
ইমানহীন অবস্থায় মৃত্যু হলে চিরকাল জাহান্নাম
-
কঠিন হিশাব ও শাস্তি
কালো জাদু থেকে বাঁচার ইসলামি উপায়
১. কুরআন পাঠ ও তিলাওয়াত
-
সুরা আল-বাকারা: শয়তান ঘরে প্রবেশ করে না।
-
আয়াতুল কুরসি (২:২৫৫)
-
সুরা ফালাক ও নাস
২. সকাল-সন্ধ্যার জিকির ও দোআ
নিয়মিত যিকির করা শয়তান থেকে রক্ষা করে।
৩. রুকইয়াহ (ইসলামী চিকিৎসা)
বিশুদ্ধ হাদীসভিত্তিক রুকইয়াহ কালো জাদুর প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
তওবা ও ক্ষমা পাওয়ার পথ
যে ব্যক্তি কালো জাদু করেছে বা করিয়েছে, তার জন্য আল্লাহর দরজা খোলা আছে যদি সে:
-
কাজটি ছেড়ে দেয়
-
আন্তরিক অনুশোচনা করে
-
ক্ষমা প্রার্থনা করে
-
কখনো ফিরে না যায়
বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলই মূল ঢাল
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করে, তার উপর কালো জাদু অল্পই প্রভাব ফেলে। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে:
“যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তাঁর জন্য তিনিই যথেষ্ট।”
— (সূরা আত-তালাক, ৬৫:৩)
ভুল ধারণা সম্পর্কে সতর্কতা
-
প্রতিটি সমস্যা কালো জাদুর ফল নয়।
-
সবসময় চিকিৎসা এবং ইবাদত উভয়ের মাধ্যমে সমাধান খোঁজাই উত্তম।
-
অতিরিক্ত সন্দেহ মানুষকে অবিশ্বাসী ও মানসিকভাবে দুর্বল করে।
কালো জাদু ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি শুধু কুফরি কাজ নয় বরং মানুষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তাই মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কুরআন-হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন গঠন করা, কল্যাণ ও শান্তির পথে থাকা এবং শয়তানের ধোঁকায় না পড়ে সতর্ক থাকা।
প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১. সব ধরণের জাদুই কি হারাম?
হ্যাঁ, বিশেষ করে যেগুলো জ্বিন বা অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে হয় তা হারাম এবং কুফরি।
২. জাদু কি ভাঙা সম্ভব?
হ্যাঁ, রুকইয়াহ ও কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে ভাঙা যায়।
৩. আমি বুঝতে পারছি না, আমার উপর জাদু হচ্ছে কিনা—কি করবো?
প্রথমে চিকিৎসা এবং রুকইয়াহ একসাথে করান। মনে রাখবেন, আতঙ্ক নয় বরং ইমানই আপনার রক্ষা।
৪. জাদু বিশ্বাস করা কি গুনাহ?
জাদুর অস্তিত্ব বিশ্বাস করা ইসলামী দৃষ্টিকোণে বৈধ, তবে আল্লাহর চাইতে এর ক্ষমতা বেশি মনে করা শিরক।
৫. কোনোভাবে জাদুকরের কাছে গিয়েছিলাম, কী করবো?
তওবা করুন, ভুল স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং ভবিষ্যতে তা থেকে দূরে থাকুন।
রাসূল ﷺ-এর সুন্নাহ মেনে চলা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য।