০১:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ অগাস্ট ২০২৫
কুরবানির ইতিহাস আদম (আঃ)-এর যুগ থেকেই শুরু হয়ে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা

কুরবানীর ইতিহাস : কুরআন ও হাদিসের আলোকে

Monirujjaman
  • আপডেট সময়ঃ ০৯:৫৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
  • / ৪৪ বার পড়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রোজা রাখার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা: এক গভীর বিশ্লেষণ

কুরবানির পরিচয়-
“কুরবানি” শব্দটি আরবি “قربان” (কুরবান) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া -তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করা। ইসলামে কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে (ঈদুল আযহার দিনে) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। এটি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন, যা কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য এক মহৎ ইবাদত হিসেবে স্থায়ী করা হয়েছে।

কুরআনের ভাষ্যমতে, কুরবানির ইতিহাস আদম (আঃ)-এর যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:“আর আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়ে একটি কুরবানি করেছিল। তখন তাদের এক জনের কুরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপর জনেরটা কবুল হয়নি।”-(সূরা মায়েদাহ: ২৭)-

হযরত আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করেছিল।

হাবীল আল্লাহভীরু ছিল বলে তার কুরবানি কবুল হয়, আর কাবীলের হয়নি।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ত্যাগ-
কুরবানি ইবাদতের মূল ভিত্তি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয়। তিনি আল্লাহর আদেশে নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কুরআন বলছে:

“তারপর যখন ইসমাইলের পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়স হলো,তখন ইব্রাহিম নবী বললেন, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন বলো, তুমি কী মনে করো?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদেশ পাচ্ছেন তা-ই করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’”
(সূরা সাফফাত: ১০২)

এরপর যখন ইব্রাহিম (আঃ) তাঁকে জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন:“আর আমি তাকে (ইসমাইল) বদলে দিলাম এক মহান কুরবানির মাধ্যমে।”
(সূরা সাফফাত: ১০৭)

এখানে মহান কুরবানির অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলা ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি বড় দুম্বা পাঠিয়ে দেন এবং ত্যাগের পরীক্ষায় ইব্রাহিম (আঃ) উত্তীর্ণ হন।

ইসলামে কুরবানির বিধান
ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে কুরবানি নেই, তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিজরতের দ্বিতীয় বছরে কুরবানির নির্দেশ দেন এবং নিজে তা পালন করেন। হাদীসে এসেছে:“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরবানি করার সামর্থ্য রাখে অথচ কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’
(সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদীস ৩১২৩)

এছাড়া নবীজী (সাঃ) মদিনায় ১০ বছর ছিলেন এবং প্রতি বছর কুরবানি করতেন।

কুরবানির উদ্দেশ্য-

কুরআনে আল্লাহ বলেন:“আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া (ভয় ও নিষ্ঠা) পৌঁছে।”
(সূরা হজ: ৩৭)-অতএব, কুরবানির মূল উদ্দেশ্য পশু জবেহ করা নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তাকওয়া অর্জন।

কুরবানির সময়
কুরবানি করা হয় ১০ই জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু করে ১২ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত, মোট তিনদিন।

নবী করীম (সাঃ) বলেন:“আজ এই দিনে আমরা কুরবানি করি, এটি আমাদের জন্য সুন্নাত।”
(বুখারি, হাদীস: ৫৫৫৮)

কুরবানির জন্য যোগ্য পশু
কুরবানির জন্য উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু ব্যবহারযোগ্য।

উট পাঁচ বছর, গরু ও মহিষ দুই বছর এবং ছাগল-ভেড়া এক বছর বয়সী হতে হবে।

পশু সুস্থ, ত্রুটিমুক্ত এবং সুন্দর হওয়া উচিত।

কুরআনে এসেছে:“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর উত্তম বস্তু থেকে এবং এমন কিছু থেকে নয় যার গ্রহণযোগ্যতা তোমাদের কাছেও নেই।”
(সূরা বাকারা: ২৬৭)

কুরবানির মাংস বিতরণ-

কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“তাদের (কুরবানির পশুর) গোশত থেকে তোমরা নিজেও খাও এবং যারা চায় ও অভাবগ্রস্ত, তাদেরও খাওয়াও।

(সূরা হজ: ৩৬)-হাদীস অনুযায়ী, কুরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা উত্তম—

এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন, এক ভাগ গরীব-দুঃখী এবং এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য।

নারীদের কুরবানি
কুরবানির বিধান পুরুষ ও নারীর জন্য সমান। যেসব নারীর উপর যাকাত ফরজ, তাদের উপর কুরবানি করাও ওয়াজিব।

কুরবানির শিক্ষণীয় দিক
কুরবানির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ত্যাগ, ধৈর্য ও বিশ্বাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাই।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এর ঘটনা আমাদের শেখায় কীভাবে আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে প্রস্তুত হতে হয়।

কুরবানি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির, ত্যাগের ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বিশেষ মাধ্যম।

এ ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুমিন শেখে কীভাবে পার্থিব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয়।

আসুন, আমরা সবাই এই কুরবানির মৌসুমে ইখলাসের সঙ্গে কুরবানি করি,

ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করি এবং সমাজে সাহায্য ও সহানুভূতির বন্ধন দৃঢ় করি।


রেফারেন্সসমূহ-

আল-কুরআন: সূরা মায়েদাহ ৫:২৭, সূরা সাফফাত ৩৭:১০২-১০৭, সূরা হজ ২২:৩৬-৩৭
সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৫৫৮
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩১২৩

নিউজটি শেয়ার করুন

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

কুরবানির ইতিহাস আদম (আঃ)-এর যুগ থেকেই শুরু হয়ে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা

কুরবানীর ইতিহাস : কুরআন ও হাদিসের আলোকে

আপডেট সময়ঃ ০৯:৫৯:৫২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫

কুরবানির পরিচয়-
“কুরবানি” শব্দটি আরবি “قربان” (কুরবান) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া -তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কিছু উৎসর্গ করা। ইসলামে কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে (ঈদুল আযহার দিনে) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা। এটি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ত্যাগের স্মৃতিচিহ্ন, যা কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য এক মহৎ ইবাদত হিসেবে স্থায়ী করা হয়েছে।

কুরআনের ভাষ্যমতে, কুরবানির ইতিহাস আদম (আঃ)-এর যুগ থেকেই শুরু হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:“আর আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা সঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। যখন তারা উভয়ে একটি কুরবানি করেছিল। তখন তাদের এক জনের কুরবানি কবুল করা হয়েছিল এবং অপর জনেরটা কবুল হয়নি।”-(সূরা মায়েদাহ: ২৭)-

হযরত আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানি করেছিল।

হাবীল আল্লাহভীরু ছিল বলে তার কুরবানি কবুল হয়, আর কাবীলের হয়নি।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ত্যাগ-
কুরবানি ইবাদতের মূল ভিত্তি হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয়। তিনি আল্লাহর আদেশে নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)-কে কুরবানি করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কুরআন বলছে:

“তারপর যখন ইসমাইলের পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়স হলো,তখন ইব্রাহিম নবী বললেন, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন বলো, তুমি কী মনে করো?’ সে বলল, ‘হে আমার পিতা! আপনি যা আদেশ পাচ্ছেন তা-ই করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’”
(সূরা সাফফাত: ১০২)

এরপর যখন ইব্রাহিম (আঃ) তাঁকে জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন:“আর আমি তাকে (ইসমাইল) বদলে দিলাম এক মহান কুরবানির মাধ্যমে।”
(সূরা সাফফাত: ১০৭)

এখানে মহান কুরবানির অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলা ইসমাইল (আঃ)-এর পরিবর্তে একটি বড় দুম্বা পাঠিয়ে দেন এবং ত্যাগের পরীক্ষায় ইব্রাহিম (আঃ) উত্তীর্ণ হন।

ইসলামে কুরবানির বিধান
ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে কুরবানি নেই, তবে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিজরতের দ্বিতীয় বছরে কুরবানির নির্দেশ দেন এবং নিজে তা পালন করেন। হাদীসে এসেছে:“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কুরবানি করার সামর্থ্য রাখে অথচ কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’
(সুনানে ইবনে মাজাহ: হাদীস ৩১২৩)

এছাড়া নবীজী (সাঃ) মদিনায় ১০ বছর ছিলেন এবং প্রতি বছর কুরবানি করতেন।

কুরবানির উদ্দেশ্য-

কুরআনে আল্লাহ বলেন:“আল্লাহর কাছে পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া (ভয় ও নিষ্ঠা) পৌঁছে।”
(সূরা হজ: ৩৭)-অতএব, কুরবানির মূল উদ্দেশ্য পশু জবেহ করা নয়, বরং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং তাকওয়া অর্জন।

কুরবানির সময়
কুরবানি করা হয় ১০ই জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে শুরু করে ১২ই জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত, মোট তিনদিন।

নবী করীম (সাঃ) বলেন:“আজ এই দিনে আমরা কুরবানি করি, এটি আমাদের জন্য সুন্নাত।”
(বুখারি, হাদীস: ৫৫৫৮)

কুরবানির জন্য যোগ্য পশু
কুরবানির জন্য উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি পশু ব্যবহারযোগ্য।

উট পাঁচ বছর, গরু ও মহিষ দুই বছর এবং ছাগল-ভেড়া এক বছর বয়সী হতে হবে।

পশু সুস্থ, ত্রুটিমুক্ত এবং সুন্দর হওয়া উচিত।

কুরআনে এসেছে:“তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর উত্তম বস্তু থেকে এবং এমন কিছু থেকে নয় যার গ্রহণযোগ্যতা তোমাদের কাছেও নেই।”
(সূরা বাকারা: ২৬৭)

কুরবানির মাংস বিতরণ-

কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“তাদের (কুরবানির পশুর) গোশত থেকে তোমরা নিজেও খাও এবং যারা চায় ও অভাবগ্রস্ত, তাদেরও খাওয়াও।

(সূরা হজ: ৩৬)-হাদীস অনুযায়ী, কুরবানির মাংস তিনভাগে ভাগ করা উত্তম—

এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন, এক ভাগ গরীব-দুঃখী এবং এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য।

নারীদের কুরবানি
কুরবানির বিধান পুরুষ ও নারীর জন্য সমান। যেসব নারীর উপর যাকাত ফরজ, তাদের উপর কুরবানি করাও ওয়াজিব।

কুরবানির শিক্ষণীয় দিক
কুরবানির মাধ্যমে আমরা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ত্যাগ, ধৈর্য ও বিশ্বাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাই।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)-এর ঘটনা আমাদের শেখায় কীভাবে আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে প্রস্তুত হতে হয়।

কুরবানি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির, ত্যাগের ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি বিশেষ মাধ্যম।

এ ইবাদতের মাধ্যমে একজন মুমিন শেখে কীভাবে পার্থিব ভালোবাসার ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয়।

আসুন, আমরা সবাই এই কুরবানির মৌসুমে ইখলাসের সঙ্গে কুরবানি করি,

ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করি এবং সমাজে সাহায্য ও সহানুভূতির বন্ধন দৃঢ় করি।


রেফারেন্সসমূহ-

আল-কুরআন: সূরা মায়েদাহ ৫:২৭, সূরা সাফফাত ৩৭:১০২-১০৭, সূরা হজ ২২:৩৬-৩৭
সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৫৫৮
সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩১২৩