০১:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৫
মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত কী?

মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত কী?

Ahsan Habib
  • আপডেট সময়ঃ ১০:৩৩:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
  • / ৪৮ বার পড়া হয়েছে।

নবীজির (সা.) সুন্নাত মেনে চলার ফজিলত ও অমান্য করার শাস্তি

ইসলামী বিশ্বাসে মৃত্যু কেবল জীবনের ইতি নয়; বরং এটি এক অনন্ত জীবনের সূচনা। একজন মু’মিনের জন্য মরার স্থানও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি সেই স্থান হয় মক্কা বা মদীনা — ইসলামের দুই পবিত্রতম শহর। এই দুই শহরে ইন্তিকাল হওয়া মানে মৃত্যুর পর এক বিরাট ফজিলত ও নিরাপত্তা লাভ। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কিরাম এই ফজিলতের কথা আমাদের জানিয়েছেন।

এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত আলোচনা করবো।


১. মদীনায় মৃত্যু: রাসূল ﷺ-এর বিশেষ দোয়া

রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় মৃত্যুর জন্য দোয়া করতেন এবং মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মদীনায় মৃত্যুর তাওফিক দাও এবং আমাকে সেখানে দাফন করো।”— (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ১২১৭৯)🔹 এই দোয়া প্রমাণ করে যে, মদীনায় মৃত্যু রাসূল ﷺ-এর কাছেও কাঙ্ক্ষিত ছিল। যখন রাসূলের দোয়ার বিষয় হয়—তা অবশ্যই ফজিলতপূর্ণ।


২. মদীনায় ইন্তিকালের বিশেষ ফজিলত

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:“যে ব্যক্তি ধৈর্যের সঙ্গে মদীনায় বসবাস করবে এবং সেখানে মারা যাবে, আমি কিয়ামতের দিনে তার জন্য সুপারিশ করব।”— (তিরমিজি, হাদীস: ৩৯১৭)🔹 রাসূল ﷺ-এর সুপারিশ (শাফাআত) পাওয়া একটি বিরাট নিয়ামত। এই ফজিলত কেবল তাদের জন্য, যারা মদীনায় ধৈর্যের সঙ্গে বসবাস করে এবং সেখানে ইন্তিকাল করে।


৩. জান্নাতের আশ্বাস

“যে ব্যক্তি মদীনায় মারা যাবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিনদার হব ইন শা আল্লাহ।”— (ইবনু মাজাহ, হাদীস: ৩১১২) 🔹 রাসূল ﷺ নিজেই জান্নাতের জামিন দিচ্ছেন মদীনায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য। এটি কত বড় ফজিলত তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।


৪. কা‘বা ও মক্কায় মৃত্যু: মর্যাদার প্রতীক

যদিও মদীনার মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি ফজিলতের বহু হাদীস রয়েছে, তবু মক্কায় ইন্তিকালও বিশেষ মর্যাদার। কারণ:

  • মক্কা হলো আল্লাহর ঘর কা‘বার স্থান।
  • এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান।
  • হজ ও উমরাহর কেন্দ্রবিন্দু।

“যে কেউ হারামে (মক্কা) প্রবেশ করে, সে নিরাপদ।”
— (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭)

🔹 কেউ যদি হজ বা উমরাহ করতে গিয়ে সেখানে ইন্তিকাল করে, তা শহীদির মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত।


৫. হজ ও উমরাহ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ: শহীদের মর্যাদা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:“যে ব্যক্তি হজ করতে গিয়ে মারা যায় এবং সে ইখলাসের সঙ্গে নিয়ত করেছিল, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজকারীর সাওয়াব লেখা হবে এবং সে কবর থেকে ‘লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পাঠ করতে করতে উঠবে।”— (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান)

🔹 এটি মক্কায় বা হজের সময় মৃত্যুবরণকারীর জন্য এক বিরাট ফজিলত।


৬. জান্নাতের বাগানের পাশে কবর: রাওজাহ

মসজিদে নববীতে, রাসূল ﷺ-এর কবর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় “রাওজাহ মিন রিয়াদিল জান্নাহ” — জান্নাতের বাগানের এক টুকরো।“আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান।”— (বুখারী, হাদীস: ১১৯৬)🔹 যারা মদীনায় ইন্তিকাল করেন, অনেকেই রাওজাহর পাশে বা জান্নাতুল বাকি‘তে দাফন হন — সাহাবা, তাবেঈন, ওলি-আওলিয়ারা যেখানেই বিশ্রাম নিচ্ছেন।


৭. জান্নাতুল বাকি‘: আল্লাহর প্রিয়দের বিশ্রামভূমি

  • জান্নাতুল বাকি‘ হচ্ছে মদীনার প্রধান কবরস্থান।
  • সেখানে উসমান (রা.), ইমাম হাসান (আ.), ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) সহ হাজারো সাহাবী ও তাবেয়ীন দাফন আছেন।
  • যারা বাকি‘তে দাফন হন, তাঁদের জন্য রাসূল ﷺ দোয়া করেছেন।

“হে আল্লাহ! বাকি‘র অধিবাসীদের তুমি মাফ করে দাও।”
— (মুসলিম, হাদীস: ৯৭৪)


৮. বিদ্বানদের মতামত ও ক্বিয়াস

🔸 বহু আলিম বলেন:“যে স্থানে ইবাদতের ফজিলত বেশি, সেখানে মৃত্যুর ফজিলতও বেশি।”— (ইমাম নববী, শারহু মুসলিম)

🔸 হাফিয ইবনুল কায়্যিম বলেন:“মক্কা-মদীনায় মৃত্যু ঈমানের পরিপূর্ণতা এবং আখিরাতে চিরস্থায়ী সম্মানের নিদর্শন।”


মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকাল হওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। এটি হলো এমন এক মৃত্যু যা জান্নাতের দরজা খুলে দেয়। মদীনায় ইন্তিকাল হলে রাসূল ﷺ-এর সুপারিশের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আর মক্কায় ইন্তিকাল হলে আল্লাহর ঘরের সামনে দাফনের সৌভাগ্য। তাই অনেক বুযুর্গ, ওলি-আউলিয়া এই শহরদ্বয়ে জীবন শেষ করতে আকুলপ্রাণ ছিলেন।

আমরাও যেন ঈমান সহকারে জীবন যাপন করে আল্লাহর প্রিয় শহরগুলোর বরকতে আমাদের অন্তিম পরিণতি লাভ করতে পারি—এই প্রার্থনাই থাক।


📚 তথ্যসূত্র:

  1. কুরআন: সূরা আলে ইমরান (৩:৯৭)
  2. সহীহ বুখারী: হাদীস ১১৯৬
  3. সহীহ মুসলিম: হাদীস ৯৭৪
  4. তিরমিজি: হাদীস ৩৯১৭
  5. ইবনু মাজাহ: হাদীস ৩১১২
  6. মুসনাদে আহমদ: হাদীস ১২১৭৯
  7. শু‘আবুল ঈমান (বায়হাকী)
  8. তাফসীর ইবনে কাসীর ও শারহু মুসলিম

নিউজটি শেয়ার করুন

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত কী?

মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত কী?

আপডেট সময়ঃ ১০:৩৩:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

ইসলামী বিশ্বাসে মৃত্যু কেবল জীবনের ইতি নয়; বরং এটি এক অনন্ত জীবনের সূচনা। একজন মু’মিনের জন্য মরার স্থানও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি সেই স্থান হয় মক্কা বা মদীনা — ইসলামের দুই পবিত্রতম শহর। এই দুই শহরে ইন্তিকাল হওয়া মানে মৃত্যুর পর এক বিরাট ফজিলত ও নিরাপত্তা লাভ। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবায়ে কিরাম এই ফজিলতের কথা আমাদের জানিয়েছেন।

এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকালের ফজিলত আলোচনা করবো।


১. মদীনায় মৃত্যু: রাসূল ﷺ-এর বিশেষ দোয়া

রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় মৃত্যুর জন্য দোয়া করতেন এবং মুসলমানদেরও এ ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মদীনায় মৃত্যুর তাওফিক দাও এবং আমাকে সেখানে দাফন করো।”— (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ১২১৭৯)🔹 এই দোয়া প্রমাণ করে যে, মদীনায় মৃত্যু রাসূল ﷺ-এর কাছেও কাঙ্ক্ষিত ছিল। যখন রাসূলের দোয়ার বিষয় হয়—তা অবশ্যই ফজিলতপূর্ণ।


২. মদীনায় ইন্তিকালের বিশেষ ফজিলত

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:“যে ব্যক্তি ধৈর্যের সঙ্গে মদীনায় বসবাস করবে এবং সেখানে মারা যাবে, আমি কিয়ামতের দিনে তার জন্য সুপারিশ করব।”— (তিরমিজি, হাদীস: ৩৯১৭)🔹 রাসূল ﷺ-এর সুপারিশ (শাফাআত) পাওয়া একটি বিরাট নিয়ামত। এই ফজিলত কেবল তাদের জন্য, যারা মদীনায় ধৈর্যের সঙ্গে বসবাস করে এবং সেখানে ইন্তিকাল করে।


৩. জান্নাতের আশ্বাস

“যে ব্যক্তি মদীনায় মারা যাবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জামিনদার হব ইন শা আল্লাহ।”— (ইবনু মাজাহ, হাদীস: ৩১১২) 🔹 রাসূল ﷺ নিজেই জান্নাতের জামিন দিচ্ছেন মদীনায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য। এটি কত বড় ফজিলত তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে।


৪. কা‘বা ও মক্কায় মৃত্যু: মর্যাদার প্রতীক

যদিও মদীনার মৃত্যু সম্পর্কে সরাসরি ফজিলতের বহু হাদীস রয়েছে, তবু মক্কায় ইন্তিকালও বিশেষ মর্যাদার। কারণ:

  • মক্কা হলো আল্লাহর ঘর কা‘বার স্থান।
  • এটি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান।
  • হজ ও উমরাহর কেন্দ্রবিন্দু।

“যে কেউ হারামে (মক্কা) প্রবেশ করে, সে নিরাপদ।”
— (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭)

🔹 কেউ যদি হজ বা উমরাহ করতে গিয়ে সেখানে ইন্তিকাল করে, তা শহীদির মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত।


৫. হজ ও উমরাহ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ: শহীদের মর্যাদা

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:“যে ব্যক্তি হজ করতে গিয়ে মারা যায় এবং সে ইখলাসের সঙ্গে নিয়ত করেছিল, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজকারীর সাওয়াব লেখা হবে এবং সে কবর থেকে ‘লাব্বাইকাল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ পাঠ করতে করতে উঠবে।”— (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান)

🔹 এটি মক্কায় বা হজের সময় মৃত্যুবরণকারীর জন্য এক বিরাট ফজিলত।


৬. জান্নাতের বাগানের পাশে কবর: রাওজাহ

মসজিদে নববীতে, রাসূল ﷺ-এর কবর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় “রাওজাহ মিন রিয়াদিল জান্নাহ” — জান্নাতের বাগানের এক টুকরো।“আমার ঘর ও মিম্বারের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান।”— (বুখারী, হাদীস: ১১৯৬)🔹 যারা মদীনায় ইন্তিকাল করেন, অনেকেই রাওজাহর পাশে বা জান্নাতুল বাকি‘তে দাফন হন — সাহাবা, তাবেঈন, ওলি-আওলিয়ারা যেখানেই বিশ্রাম নিচ্ছেন।


৭. জান্নাতুল বাকি‘: আল্লাহর প্রিয়দের বিশ্রামভূমি

  • জান্নাতুল বাকি‘ হচ্ছে মদীনার প্রধান কবরস্থান।
  • সেখানে উসমান (রা.), ইমাম হাসান (আ.), ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) সহ হাজারো সাহাবী ও তাবেয়ীন দাফন আছেন।
  • যারা বাকি‘তে দাফন হন, তাঁদের জন্য রাসূল ﷺ দোয়া করেছেন।

“হে আল্লাহ! বাকি‘র অধিবাসীদের তুমি মাফ করে দাও।”
— (মুসলিম, হাদীস: ৯৭৪)


৮. বিদ্বানদের মতামত ও ক্বিয়াস

🔸 বহু আলিম বলেন:“যে স্থানে ইবাদতের ফজিলত বেশি, সেখানে মৃত্যুর ফজিলতও বেশি।”— (ইমাম নববী, শারহু মুসলিম)

🔸 হাফিয ইবনুল কায়্যিম বলেন:“মক্কা-মদীনায় মৃত্যু ঈমানের পরিপূর্ণতা এবং আখিরাতে চিরস্থায়ী সম্মানের নিদর্শন।”


মক্কা ও মদীনায় ইন্তিকাল হওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়। এটি হলো এমন এক মৃত্যু যা জান্নাতের দরজা খুলে দেয়। মদীনায় ইন্তিকাল হলে রাসূল ﷺ-এর সুপারিশের প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আর মক্কায় ইন্তিকাল হলে আল্লাহর ঘরের সামনে দাফনের সৌভাগ্য। তাই অনেক বুযুর্গ, ওলি-আউলিয়া এই শহরদ্বয়ে জীবন শেষ করতে আকুলপ্রাণ ছিলেন।

আমরাও যেন ঈমান সহকারে জীবন যাপন করে আল্লাহর প্রিয় শহরগুলোর বরকতে আমাদের অন্তিম পরিণতি লাভ করতে পারি—এই প্রার্থনাই থাক।


📚 তথ্যসূত্র:

  1. কুরআন: সূরা আলে ইমরান (৩:৯৭)
  2. সহীহ বুখারী: হাদীস ১১৯৬
  3. সহীহ মুসলিম: হাদীস ৯৭৪
  4. তিরমিজি: হাদীস ৩৯১৭
  5. ইবনু মাজাহ: হাদীস ৩১১২
  6. মুসনাদে আহমদ: হাদীস ১২১৭৯
  7. শু‘আবুল ঈমান (বায়হাকী)
  8. তাফসীর ইবনে কাসীর ও শারহু মুসলিম