মদিনার মর্যাদা ও ফজিলত: দলিলভিত্তিক একটি প্রামাণ্য আলোচনা
মদিনার মর্যাদা ও ফজিলত: দলিলভিত্তিক প্রামাণ্য আলোচনা

- আপডেট সময়ঃ ১০:২৩:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ৬০ বার পড়া হয়েছে।
মদিনা বা আল-মাদিনা আল-মুনাওয়ারাহ — ইসলামের ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা এবং মুসলমানদের হৃদয়ে এক অবিস্মরণীয় নাম। এটি শুধু একটি শহর নয়, বরং ইসলামের প্রথম রাষ্ট্র, বিশ্বব্যাপী ইসলামী সভ্যতার সূতিকাগার এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর চিরনিদ্রার স্থান। মক্কা যেখানে ইসলামের সূচনা, সেখানে মদিনা হল তার বিকাশের কেন্দ্র। এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন, হাদীস এবং ওলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যার আলোকে মদিনার মর্যাদা ও ফজিলত বিশ্লেষণ করব।
১. মদিনার ইতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মদিনা পূর্বে ‘ইয়াসরিব’ নামে পরিচিত ছিল, যেখানে আরব ও ইহুদি গোত্র বাস করত। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কায় অমানবিক নির্যাতনের পর ইহুদি ও আনসারদের দাওয়াতে সেখানে হিজরত করেন। এই হিজরতই ইসলামী বর্ষপঞ্জির সূচনা হয়।
পরবর্তীতে ইয়াসরিবের নাম হয় মদীনাতুন্নবী (নবীর শহর) এবং আল-মাদিনা আল-মুনাওয়ারাহ (উজ্জ্বল শহর)। এটি ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী এবং ইসলামের বিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
২. কুরআনে মদিনার মর্যাদা-
যদিও কুরআনে “মদিনা” নামটি সরাসরি কম উল্লেখ আছে, তবে মদিনার অধিবাসীদের প্রশংসা করা হয়েছে:
“আর যারা তাদের (মুহাজিরদের) আগেই বসবাস করেছিল মদিনায় এবং ঈমান এনেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালোবাসে এবং তাদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে সে ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনো হিংসা বোধ করে না।”-(সূরা আল-হাশর, ৫৯:৯)
এই আয়াতে মদিনার আনসারদের আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার প্রশংসা করা হয়েছে।
৩. রাসূল (সা.)-এর মদিনার প্রতি ভালোবাসা
রাসূলুল্লাহ ﷺ মদিনাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং এর জন্য বিশেষ দোয়া করতেন:“হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে মক্কাকে আমাদের নিকট প্রিয় করেছ, তার চেয়েও অধিক হারে মদিনাকে প্রিয় কর।”-(সহীহ বুখারী, ১৮৮৯; সহীহ মুসলিম, ১৩৭৬)
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, রাসূল ﷺ মদিনাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং মুসলমানদের হৃদয়েও এর ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত হোক তা কামনা করতেন।
৪. ফেরেশতা দ্বারা রক্ষিত শহর
রাসূল (সা.) বলেছেন:“মদিনার প্রতিটি প্রবেশপথে ফেরেশতা নিয়োজিত রয়েছে, সেখানে প্লেগ ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না।”-(সহীহ বুখারী, ১৮৮০; সহীহ মুসলিম, ২৯৪৩)
এই হাদীস প্রমাণ করে যে, মদিনা আল্লাহর পক্ষ থেকে রক্ষিত একটি শহর — কিয়ামত পর্যন্ত এর পবিত্রতা বজায় থাকবে।
৫. মসজিদে নববী ও এর ফজিলত
মদিনার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে মসজিদে নববী, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ নিজ হাতে নির্মাণ করেছিলেন। এটি ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম মসজিদ।“আমার এই মসজিদে এক রাকাত নামাজ অন্যান্য মসজিদের এক হাজার নামাজ অপেক্ষা উত্তম, মসজিদুল হারাম ছাড়া।”-(সহীহ বুখারী, ১১৯০; সহীহ মুসলিম, ১৩৯৪)
এই হাদীস অনুযায়ী, মসজিদে নববীতে নামাজ পড়া এক বিরল সওয়াবের সুযোগ।
৬. রওজা মোবারক ও রওজার ফজিলত
রাসূল ﷺ–এর কবর মসজিদে নববীর পাশে তার ঘরের মধ্যেই রয়েছে। সেই ঘরের একাংশ সম্পর্কে রাসূল বলেন:“আমার ঘর ও মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান।”-(সহীহ বুখারী, ১১৯৬; সহীহ মুসলিম, ১৩৯০)
এই স্থান, যাকে রওদাহ বলা হয়, সেখানে নামাজ পড়া এবং দোয়া করাকে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ বলে গণ্য করা হয়।
৭. বরকতের দোয়া ও ফলাফল
রাসূল ﷺ মদিনার জন্য নির্দিষ্ট বরকতের দোয়া করেছেন:-“হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের মদিনায় বরকত দান করো — আমাদের মাপে, আমাদের খাদ্যে।”-(সহীহ বুখারী, ২১২৯)
এই দোয়া মদিনাকে আধ্যাত্মিক ও পার্থিব দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছে।
৮. নিরাপত্তার শহর হিসেবে ঘোষণা
রাসূল ﷺ বলেছেন:“ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে হারাম ঘোষণা করেছিলেন, আর আমি মদিনাকে হারাম ঘোষণা করছি — এর দুই পাহাড়ের মাঝখানে। কেউ এখানে গাছ কাটবে না বা রক্ত ঝরাবে না।”-(সহীহ মুসলিম, ১৩৭২)
এই হাদীস মদিনার পবিত্রতা ও আইনগত মর্যাদা ঘোষণা করে।
৯. কিয়ামতের পূর্বভাগে মদিনার গুরুত্ব
রাসূল ﷺ বলেছেন:-“ঈমান মদিনায় আশ্রয় নেবে, যেমন সাপ তার গর্তে ফিরে যায়।”-(সহীহ বুখারী, ১৮৭৬)
এই হাদীস ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, এক সময়ে পৃথিবীতে ফিতনা ছড়িয়ে পড়লেও মদিনা ঈমানদারদের আশ্রয়স্থল হয়ে থাকবে।
১০. ওলামায়ে কেরামের ব্যাখ্যা
- ইমাম নববী (রহ.) বলেছেন: “মদিনায় বসবাস করা, সেখানে মৃত্যু ও দাফন হওয়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।”
- ইবনে তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন: “মদিনা হচ্ছে নবীর শহর, ইসলামি হিজরতের কেন্দ্র এবং এটি এমন মর্যাদাসম্পন্ন শহর যা কেবল সুন্নাহ জ্ঞানী ব্যাক্তিরাই উপলব্ধি করতে পারে।”
মদিনা শুধুমাত্র একটি স্থান নয়, এটি হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস, হৃদয়, সভ্যতা ও ভালোবাসার প্রতীক। এখানে ইসলামের সমাজ কাঠামো গড়ে ওঠে, নবীজির জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর চিরশান্তি লাভ ঘটে।
হজের মতো মদিনা সফর ফরজ নয়, কিন্তু এর ফজিলত ও মাহাত্ম্য এমন যে, প্রতিটি মুসলমানের হৃদয় তৃষ্ণার্ত থাকে মদিনার বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। মদিনা এমন একটি শহর, যেখানে পৌঁছানো মানে আধ্যাত্মিকভাবে নবীর ﷺ সান্নিধ্যে আসা।
তথ্যসূত্র (References):
- কুরআন: সূরা আল-হাশর (৫৯:৯)
- সহীহ বুখারী – হাদীস: ১১৯০, ১৮৮৯, ১৮৮০, ১৮৭৬
- সহীহ মুসলিম – হাদীস: ১৩৭২, ১৩৯৪, ২৯৪৩
- ইমাম নববী – শারহ সহীহ মুসলিম
- মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া – ইবনে তাইমিয়্যা