মদিনা জিয়ারত কি হজের অংশ? দলিলসহ বিশ্লেষণ
মদিনা জিয়ারত কি হজের অংশ? দলিলসহ বিশ্লেষণ

- আপডেট সময়ঃ ০৮:৫২:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ১৩৫ বার পড়া হয়েছে।
দলিলসহ বিশ্লেষণ-(চূড়ান্ত জবাব ও বিশ্লেষণমূলক সমাধান সর্বশেষে দেয়া হয়েছে)
হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি, যা প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জীবনে অন্তত একবার পালন করা ফরজ।
কিন্তু একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো—হজের অংশ হিসেবে কি মদিনা জিয়ারত করা আবশ্যক?
অনেক মুসলমান হজ পালনের আগে বা পরে মদিনা যান এবং নবী (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করেন।
এই লেখায় কুরআন, হাদীস ও ওলামায়ে কেরামের বক্তব্যের আলোকে বিশ্লেষণ করা হবে—মদিনা জিয়ারত হজের অংশ কিনা।
জিয়ারতের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব:
‘জিয়ারত’ শব্দটি সাধারণত কোনো পবিত্র স্থান বা ব্যক্তিত্বের কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
ইসলামি প্রেক্ষাপটে এটি বিশেষ করে মদীনায় রাসূল (সা.)-এর রওজা শরীফ ও মসজিদে নববী পরিদর্শনকে নির্দেশ করে।
এটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হিসেবে বিবেচিত।
মদিনা জিয়ারত কি হজের আনুষ্ঠানিক অংশ?
প্রখ্যাত ইসলামি পণ্ডিতদের সর্বসম্মত মত হলো—
মদিনা জিয়ারত হজের ফরজ বা ওয়াজিব কোনো অংশ নয়। হজের সব রুকন বা আনুষ্ঠানিকতা কেবল মক্কা ও আশেপাশের স্থান যেমন
—মিনা, আরাফা ও মুযদালিফায় সম্পাদিত হয়।আমল ও ফরজ হিসেবে করণীয় কাজ এ কয়েক স্থানেই সীমাবদ্ধ।
কুরআনের দলিল: আল্লাহ তাআলা বলেন:“তবে যারা সেখানে (মক্কায়) যাওয়ার সামর্থ্য রাখে, তাদের উপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহর হজ করা ফরজ।”
(সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭)এই আয়াতে কেবল বাইতুল্লাহর হজের কথা বলা হয়েছে, মদিনা বা নবীর কবর জিয়ারতের কথা নেই।
সুতরাং, এটি হজের ফরজ অংশ নয়।
হাদীসের দলিল:
১. তিনটি মসজিদ ছাড়া সফরের নিষেধাজ্ঞা:
রাসূল (সা.) বলেন:“তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য কোনো মসজিদে সফরের জন্য নিজেকে কষ্ট দিও না—এই আমার মসজিদ (মসজিদে নববী), মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসা।
“(সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৯৭) এই হাদীস মসজিদে নববীর ফজিলতকে তুলে ধরে, কিন্তু হজের অংশ হিসেবে নয়।
২. মসজিদে নববীতে নামাজের ফজিলত:
“আমার এই মসজিদে একটি নামাজ অন্যান্য যেকোনো মসজিদের এক হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম, মসজিদুল হারাম ছাড়া।
“(সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৯৪) এই হাদীসেও জিয়ারতের ফজিলত আছে, কিন্তু হজের অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক নয়।
৩. নবীজীর রওজা শরীফ জিয়ারতের ফজিলত:
“যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমাকে জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমাকে জিয়ারত করলো।
“(সুনান দারকুতনি; যদিও হাদীসটি দুর্বল হিসাবে পরিগণিত) দুর্বল হলেও, বহু আলিম ও তাবিয়ীন এই আমলকে মুস্তাহাব হিসেবে নিয়েছেন। অর্থাৎ, এটি হজের অংশ নয়, কিন্তু ফজিলতপূর্ণ।
ওলামায়ে কেরামের মতামত:
১. ইমাম নববী (রহ.):তিনি আল-মাজমু’ কিতাবে বলেন:
“হজে গমনকারী মুসলমানের জন্য রাসূল (সা.)-এর কবর জিয়ারত করা সুন্নত ও মুস্তাহাব কাজ, তবে এটি হজের অংশ নয়।”
2. বর্তমান যুগের ওলামা:সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটি (Lajnah al-Da’imah) বলেছেন:
“মসজিদে নববী জিয়ারত হজ বা উমরার শর্ত নয়, তবে এটি সুন্নত ও প্রশংসনীয়।”
তালিকাভিত্তিক সারাংশ:
বিষয় | ব্যাখ্যা |
---|---|
হজের অংশ কি? | ❌ না |
সুন্নত বা মুস্তাহাব কি? | ✅ হ্যাঁ |
কুরআনে উল্লেখ আছে কি? | ❌ না |
হাদীসে উৎসাহিত করা হয়েছে? | ✅ হ্যাঁ (বিশেষ করে মসজিদে নববীর ফজিলত) |
ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমত | সুন্নত, তবে হজের অংশ নয় |
সব কথা জানার পর,এবার আসুন ধার্মিকতা ও ঈমানদারিতার দিক থেকে জবাব পাওয়া যাক:
একটি হাদিস আপনাকে কাঙ্খিত জবাব দিয়ে দেবে।নবীজি বলেন-
“من حج البيت ولم يزرني فقد جفاني”“যে হজ করল কিন্তু আমাকে জিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি অবজ্ঞা করল।
“— (সুনান দারকুতনী, বাইহাকি, ইমাম সবকী “শিফাউস সিকাম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)
🔹 রাসূল ﷺ-কে জিয়ারত না করা অবজ্ঞা স্বরূপ। এটি তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভাব নির্দেশ করে।
হজ হলো একটি ফরজ ইবাদত।তাও শর্ত সাপেক্ষে সেটি ফরজ।
যদি সামর্থ্য না থাকে,তবে এমন কারো উপর ফরজ নয়।সামর্থহীন কেউ যদি হজ না করে ইন্তিকাল করে,তাহলে সে অপরাধী হবে না।
কিন্তু মুসলিম তথা সামর্থবান হউক আর এ হউক,প্রত্যেকের উপর নবীজিকে আল্লাহর পরে প্রাধান্য দেয়া ফরজ।
অবজ্ঞা না করা ফরজ ও অবজ্ঞা করা নবীজিকে কষ্ট দেয়ার সামিল।যার কারণে আল্লাহ তালাও কষ্ট পান।
ফলে বান্দা আমল করতে গিয়েও যদি অবজ্ঞার মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূলকে কষ্টদেয়, আল্লাহ বলেন –
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য লাঞ্ছনাজনক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।
”— সূরা আহ্যাব, ৩৩:৫৭
🔹 এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ ও রাসূলকে কষ্ট দেয়, তাদের উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ) রয়েছে এবং তাদের জন্য রয়েছে বেহুদা অপমানজনক শাস্তি এবং আমলের কোন ক্ষেত্রেও নবীজিকে অবজ্ঞা করার ক্ষমা নেই।
এমন কিছু করলে সেই বান্দার প্রতি সবার আগে স্বয়ং আল্লাহ নারাজ হয়ে যান এবং তার আমল কবুল হওয়ার আর সম্ভাবনা থাকে না।
সুতরাং
নবীজির প্রতি অবজ্ঞার কাজ যদি তিনার হাদিসের ভাষ্যমতেই হয়ে যায়,তাহলে ফলাফল কেমন হবে তা আশা করি আমরা বুঝে গিয়েছি।কখনোই তা কল্যাণকর হবে না।
এটুকু আলোচনায় কুরআন,হাদিস,ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে চূড়ান্ত জবাব হলো –
কেবল হজ-ই নয়,বরং সকল ক্ষেত্রেই নবীজিকে প্রাধান্য দেয়া ওয়াজিব এবং অবজ্ঞা করে কষ্ট দেয়া থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরজ।
যেটি স্পষ্ট ভাবে আমাদেরকে শেখায় যে,হজ করতে গিয়ে নবীজির রওজা মোবারক জেয়ারত করতে যাওয়া মুমিনের জন্য ওয়াজিব
-হজ কবুল হওয়ার স্বার্থে নবীজিকে অবজ্ঞা না করা লাজেম বা আবশ্যক।
মুসলমান হিসেবে রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থেকেই আমরা মদিনা জিয়ারত করতে আগ্রহী হই।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে হজ পালন করুন, আর মদিনা জিয়ারতের মাধ্যমে নবীজির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করুন।
মদিনা সফর বা রওজা জিয়ারত যদিও হজের অংশ নয়,তবে হজ করতে যাওয়া প্রত্যেক হাজীদের জন্য কল্যাণকর,সায়াবপূর্ণ ও ইমানদারিতা হলো
-মদিনায় উপস্থিত হওয়া এবং নবীজির জিয়ারত করা।
কেননা হজ করলে বান্দার ফরজ আদায় হয় আর নবীজির জিয়ারতে উম্মতের জন্য দুনিয়া আখিরাতের মুক্তি অর্জন হয়।
- মদিনা জিয়ারত হজের কোনো রুকন, ফরজ বা ওয়াজিব নয় কিন্তু মুমিনের জন্য ওয়াজিব। কারণ হজে গিয়ে জিয়ারতে না গেলে নবীজিকে অবজ্ঞা করা হয়।নবীজিকে অবজ্ঞা করার পর কারো হজ কবুল হওয়ার সুযোগ থাকে না।
- হয়তো হজ আদায় হয় মক্কার মাটিতে কিন্তু তা কবুল হয় মদিনার জিয়ারতে।সুতরাং জিয়ারত করা হজের জন্য করণীয় আহকামের অন্তর্ভুক্ত না হলেও,ঈমান ও কবুলিয়াতের জন্য এটি প্রত্যেক হাজি সাহেবের জন্য ওয়াজিব বা আবশ্যক।
- এটি সুন্নত ও ফজিলতপূর্ণ আমল—বিশেষ করে রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি মাধ্যম।
- হজ সম্পন্ন হলেও যদি কেউ মদিনায় না যায়, তার হজ বাতিল হবে না।কিন্তু নবীজিকে অবজ্ঞা করার মতো কষ্ট দেয়ার ফলে সেই হজ কবুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।
- যারা মদিনায় যান, তারা অতিরিক্ত সওয়াব অর্জনের সুযোগ পান।হজ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অর্জন করেন এবং নবীজির শাফায়াতের গ্যারান্টি পান।