রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা অতুলনীয়। তিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)
নবীজির রওজা শরীফ জিয়ারতের ফজিলত ও প্রয়োজনীয়ত

- আপডেট সময়ঃ ০৯:১১:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ৬১ বার পড়া হয়েছে।

ইসলামে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা অতুলনীয়। তিনি শুধু মানব জাতির জন্যই নয়, সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)
ইসলামে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মর্যাদা অতুলনীয়। তিনি শুধু মানব জাতির জন্যই নয়, সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত (সূরা আম্বিয়া: ১০৭)। তাঁর রওজা শরীফ (মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে অবস্থিত কবর) জিয়ারত করা শুধু একটি ঐতিহাসিক ভ্রমণ নয়, বরং তা একটি আত্মিক, ইবাদতসুলভ আমল যার মাধ্যমে মুমিন তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আনুগত্য ও ইমানের পূর্ণতা প্রকাশ করে।
১. কুরআনের দৃষ্টিতে নবীজিকে জিয়ারতের প্রমাণ-
আল্লাহ তাআলা বলেন:“যখন তারা নিজেদের উপর জুলুম করে, যদি তোমার নিকট (হে মুহাম্মদ) আসতো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতো, আর রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইতো, তবে তারা আল্লাহকে ক্ষমাশীল, দয়ালু পেতো।”— (সূরা নিসা: ৬৪)
🔹 এ আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে, রাসূল ﷺ-এর দরবারে হাযির হয়ে তাঁর কাছে সুপারিশ (শাফা’আত) চাওয়া বৈধ, এমনকি তা তাঁর ইন্তেকালের পরও। বহু মুফাসসির এই আয়াতকে তাঁর কবর জিয়ারতের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (তাফসীর কুরতুবি, আয়াত ৪:৬৪)
২. হাদীসের আলোকে রওজা শরীফ জিয়ারতের ফজিলত-
(ক) হাদীস: “আমার কবর জিয়ারত করো”-“من زار قبري وجبت له شفاعتي”-“যে আমার কবর জিয়ারত করবে, তার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হয়ে যাবে।”
— (মুসনাদে দারকুতনী, হাদীস: ২, সহীহ হিসেবে ইমাম সাখাওয়ী এবং ইবনু হাজার উল্লেখ করেছেন)
🔹 এই হাদীস রাসূল ﷺ-এর কবর জিয়ারতের স্পষ্ট ফজিলত বোঝায়। তাঁর শাফা’আত লাভের এক গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো রওজা জিয়ারত।
(খ) হাদীস: “একবার হজ ও আমার জিয়ারত”-
“من حج البيت ولم يزرني فقد جفاني”“যে হজ করল কিন্তু আমাকে জিয়ারত করল না, সে আমার প্রতি অবজ্ঞা করল।”
— (সুনান দারকুতনী, বাইহাকি, ইমাম সবকী “শিফাউস সিকাম” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)
🔹 রাসূল ﷺ-কে জিয়ারত না করা অবজ্ঞা স্বরূপ। এটি তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভাব নির্দেশ করে।
৩. সাহাবা ও তাবেঈনদের আমল-
রাসূল ﷺ-এর ইন্তেকালের পর সাহাবারা তাঁর রওজা শরীফ জিয়ারত করতেন। বিশেষ করে হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত: তিনি নবীজির কবরের পাশে গিয়ে মুখ রেখে বললেন, “আমি রাসূলের নিকট এসেছি, পাথরের কাছে নয়।”— (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৬৩৪)
🔹 সাহাবাদের এই আচরণ প্রমাণ করে যে, রওজা জিয়ারত তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৪. ইমামদের মতামত
(ক) ইমাম মালিক (রহঃ):“মদিনায় এসে নবীজির রওজা শরীফ জিয়ারত করা ওয়াজিব নয় এমন কথা বলা হলো বিদআত।”— (আল-মাদখাল, ইবনুল হাজ, ১/২৫৮)
(খ) ইমাম নববী (রহঃ):“নবীজির রওজা জিয়ারতের জন্য সফর করা মুস্তাহাব এবং অত্যন্ত বরকতময়।”— (আল-ইদাহ, ইমাম নববী)
(গ) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (যিনি কিছু ক্ষেত্রে কঠোর ছিলেন):যদিও তিনি সফরের মাধ্যমে কবর জিয়ারতের বিরোধিতা করেছিলেন, তবুও তিনি নবীজির রওজা জিয়ারতের ফজিলত অস্বীকার করেননি।
৫. রওজা শরীফ জিয়ারতের আদব ও নিয়ম-
(ক) নিয়ত:
- শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রাসূল ﷺ-এর প্রতি ভালোবাসার নিয়তে জিয়ারত করা।
(খ) সালাম পেশ:السلام عليك يا رسول الله، السلام عليك يا نبي الله، السلام عليك يا حبيب الله-এরপর হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)-কেও সালাম দেওয়া।
(গ) উচ্চ স্বরে দোয়া নয়:
- জিয়ারতের সময় কবরের সামনে উচ্চস্বরে কিছুমাত্র বলা উচিত নয়।
(ঘ) কবর ছোঁয়ার চেষ্টা না করা:
- রওজা শরীফে হাত লাগানো বা চুম্বন করা বিদআত বা গাফেলতার পরিচয় হতে পারে।
৬. রওজা শরীফ জিয়ারতের উপকারিতা-
(ক) রাসূলের ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়:
- কবর জিয়ারতের মাধ্যমে তাঁর প্রতি ভালোবাসা, ইমানের পরিপূর্ণতা অর্জিত হয়।
(খ) গুনাহ মাফ হয়:
- হাদীস অনুযায়ী, রওজা জিয়ারত করলে শাফা’আতের সুযোগ সৃষ্টি হয় যা গুনাহ মোচনের উপায়।
(গ) ইমান দৃঢ় হয়:
- রাসূল ﷺ-এর জীবনের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে দেখতে তাঁর সিরাতের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
(ঘ) আত্মিক প্রশান্তি লাভ হয়:
- রওজা শরীফের পরিবেশ, মসজিদে নববীর পবিত্রতা হৃদয়কে প্রশান্ত ও নম্র করে।
৭. কিছু ভুল ধারণা ও সংশোধন
✅ সঠিক:
- রওজা শরীফ জিয়ারত করা সুন্নাহ ও বরকতপূর্ণ আমল।
❌ ভুল ধারণা:
- কেউ কেউ বলে থাকেন, রওজা জিয়ারত শরিয়তসম্মত নয় বা তা বিদআত—এটি ভুল ও চরমপন্থী মতবাদ।
✅ সংশোধন:
- রাসূল ﷺ-এর রওজা শরীফ জিয়ারত করা সালাফ, খলাফ, ইমামগণ ও ওলিয়ায়ে কিরাম কর্তৃক প্রমাণিত আমল।
৮. ওলিয়ায়ে কিরামের দৃষ্টিতে রওজা জিয়ারতের গুরুত্ব
(ক) ইমাম গাজ্জালি (রহঃ):-“রওজা শরীফ জিয়ারতের মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং দুনিয়াবী আসক্তি দূর হয়।”
(খ) হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহঃ):-“রাসূল ﷺ-এর দরবারে জিয়ারতের সময় এমন একটি আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় যা আল্লাহর কাছে পৌঁছার পথকে সংক্ষিপ্ত করে।”
৯. জিয়ারতের সময় পাঠযোগ্য কিছু দোয়া ও দরুদ
اللهم صل على سيدنا محمد وعلى آل سيدنا محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم
— (দরুদ ইব্রাহিম)
اللهم اجعل زيارتي له شافعة لي، وبلغني شفاعته يوم القيامة، وارض عني يا أرحم الراحمين
১০. উপসংহার-
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর রওজা শরীফ জিয়ারত ইমানদারদের জন্য এক আত্মিক সফর। এটি ইবাদতের অংশ, আত্মিক উন্নতির একটি বিশেষ মাধ্যম এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। কুরআন, সহীহ হাদীস ও সালাফদের আমল থেকে প্রমাণিত হয়—এটি শরিয়তসম্মত, ফজিলতপূর্ণ ও আত্মার পবিত্রতার উপায়।
সূত্রসমূহ:
- কুরআন: সূরা নিসা ৪:৬৪, সূরা আম্বিয়া ২১:১০৭
- মুসনাদে আহমাদ
- সুনান দারকুতনী
- তাফসীর কুরতুবী
- আল-ইদাহ — ইমাম নববী
- শিফাউস সিকাম — ইমাম তকী উদ্দিন আস-সুবকী
- আল-মাদখাল — ইবনুল হাজ
- ফাতাওয়া ইমামে নববী, ইমামে মালিক, গাজ্জালি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ