০৮:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫
ইসলামে রিসালাত (নবুয়ত) কী: অর্থ, গুরুত্ব ও কুরআন-হাদীসভিত্তিক ২০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

রিসালাত শব্দের অর্থ কি? রিসালাত কাকে বলে? ২০টি প্রশ্নোত্তর FAQ

Mufty Sheikh Imran
  • আপডেট সময়ঃ ০৩:১৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
  • / ৪৪ বার পড়া হয়েছে।

রিসালাত

১. রিসালাত শব্দের অর্থ

  • “রিসালাত” (আরবি: الرّسالة / الرِّسَالَةُ) শব্দটি মূলত “প্রেরণ করা”, “পাঠানো” ইত্যাদি অর্থবহ ধাতু أ ر س لَ (अرسل) থেকে গঠিত।

  • আভিধানিক অর্থ হলো বার্তা বহন, সংবাদ পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি।

  • ইসলামী পরিভাষায় রিসালাত বলতে বোঝায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বাণী, নির্দেশ, আদেশ বা সত্য ধর্মীয় বার্তা যা নবী ও রাসুলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

  • সংক্ষেপে বলা যায়: রিসালাত = (আল্লাহর) বার্তা প্রেরণ + তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব


২. রিসালাত কাকে বলা হয়?

“রিসালাত” কার্যত সেই দায়িত্ব বা মাধ্যমকে বোঝায় যেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী ও নির্দেশ মানুষের কাছে পৌঁছায়। নিচে কিছু মূল দিক তুলে ধরা হলো:

বিষয় ব্যাখ্যা
রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়, তাঁকে রাসুল বা নবী বলা হয় (বিশেষ শর্ত থাকলে)।
নবী ও রাসুলের পার্থক্য প্রতিটি রাসুলই নবী হতে পারে। তবে প্রতিটি নবী রাসুল নয় — কারণ রাসুলগণ প্রায়ই নতুন আইন বা সর্বনবীকার্য সঙ্গে পাঠানো হয়।
রিসালাতের উদ্দেশ্য মানুষের হেদায়েত, সৎ পথ প্রদর্শন, আল্লাহর বিধান জানানো, মানুষের জীবনে ন্যায়-নৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
রিসালাত ও নবুওয়াত নবুওয়াত (নবীপ্রাপ্তি) রিসালাতের একটি রূপ—নবী ও রাসুলগণ ওহী দ্বারা বা আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী প্রাপ্ত হন এবং তা সম্প্রচার করেন।
রিসালাতের ধারাবাহিকতা আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন মানবজাতিকে প্রতি যুগে নির্দেশ ও দিশা প্রচারের জন্য।

উদাহরণ: কুরআনে আল্লাহ বলেন —
«فَبَشِّرْ عِبَادِيَ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ»
অর্থ: “তাহলে আমার সেই বান্দাদেরকে সুখবস্তু দাও, যারা কথা শুনে (সত্যতা বিবেচনা করে) সর্বোৎকৃষ্ট অনুসরণ করে।” (সূরা আল-কাসাস ২৬:৫৭)
এখানে কথাটি — “কথা শোনা → সঠিক বাণী অনুসরণ” — রিসালাতের কার্যপ্রক্রিয়া নির্দেশ করে।

নিচে ২০টি প্রশ্ন‑উত্তর দিচ্ছি রিসালাত (রাসূল / নবীপ্রেরণা) বিষয়ে, এবং প্রতিটি উত্তরে কুরআনহাদিসের দলিল (যেখানে সম্ভব) সংযুক্ত করছি — যাতে বিষয়টা স্পষ্ট ও ভিত্তিসহ থাকে:


১. রিসালাত শব্দের অর্থ কী?

উত্তর:
“রিসালাত” (আরবি: الرِّسَالَة / الرِّسَالَةُ) নামক ধাতু أ ر س لَ (arsala — প্রেরণ করা) থেকে গঠিত। অর্থ হলো প্রেরণ করা, বার্তা পৌঁছানো। ইসলামী পরিভাষায় রিসালাত বোঝায় আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বাণী বা নির্দেশ, যা নবী ও রাসুলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়


২. রিসালাত কাকে বলা হবে?

উত্তর:
যে ব্যক্তি — যে নবী বা রাসুল — আল্লাহর বাণী গ্রহণ করে (ওহী) এবং তা মানুষের কাছে প্রচার করে, তাঁকে রিসালাত বলার দায়িত্ব বা প্রক্রিয়া পালনকারী বলা যায়। অর্থাৎ, রিসালাত কেবল বার্তা নয়, সেই বার্তার গ্রহণ ও প্রচারের দায়িত্ব।


৩. রিসালাত ও নবুওয়াতের পার্থক্য কী?

উত্তর:

  • নবুওয়াত (নবীপ্রাপ্তি) হলো নবীর উদ্দেশ্যে ওহী বা ভবিষ্যদ্বাণী প্রাপ্তি।

  • রিসালাত হলো সেই প্রাপ্ত বাণীর প্রচার ও মানুষের কাছে পৌঁছানো।
    তাহলে বলা যেতে পারে: নবুওয়াত → রিসালাত।


৪. রিসালাতের উদ্দেশ্য কী?

উত্তর:
রিসালাত প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো:

  • মানুষকে সঠিক পথ দেখানো,

  • আল্লাহর আদেশ ও বিধান জানানো,

  • ন্যায় ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা,

  • মানুষকে দায়বদ্ধ করা যে তারা ঈমানী ও কর্মনিষ্ঠ হোক।


৫. কুরআনে রিসালাতের প্রমাণ কোথায়?

উত্তর:
কুরআনে বহু স্থানেই বলা হয়েছে “আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি (أَرْسَلْنَا رُسُولًا…)” — অর্থ রিসালাত প্রেরণ।

উদাহরণস্বরূপ:

  • সুরা আল-বাকারাহ আয়াত ২৫৩:

    …وَرُسُلًا بَعْضَهُمْ مِنْ بَعْضٍ…
    (আমরা একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম…)

  • সুরা হজ আয়াত ৭৭:

    …وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا…
    (আমরা তোমাকে কেবল সকল মানুষের জন্য বাসীর ও নাজীর রূপে প্রেরণ করেছি)

এই ধরনের অনেক আয়াত আছে।


৬. হাদিসে রিসালাতের প্রমাণ কী?

উত্তর:
হাদিসগুলিতেও নবী (ﷺ)-কে রিসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে।

উদাহরণ:

  1. সাহিহ বুখারিসাহিহ মুসলিম-এ আছে:

    “إِنَّما بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ”
    (নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি স mooiste মর্যাদাপূর্ণ চরিত্রসমূহকে শেষ করতে) — অর্থ: একটা দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হওয়া, যা রিসালাতের সাথে সম্পর্কিত।

  2. আরও একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে নবী (ﷺ) বলেছিলেন:

    “خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ”
    (তোমাদের মধ্যে সেরা, যে কুরআন শিখে ও শিখায়) — এখানে রিসালাত ও শিক্ষা প্রচার সম্পর্কিত দায়িত্বের প্রতি ইঙ্গিত।

(উল্লেখ্য: এখানে হাদিসের বাংলা অনুবাদ এবং মূল বর্ণনা একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।)


৭. রিসালাতের গুরুত্ব ও অব্যাহতির দিক যুক্তি সহ

উত্তর:

  • রিসালাত ঈমানের একটি মৌলধারার অংশ।

  • যদি রিসালাত বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে মানুষ আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ পেত না, ধর্ম প্রতিষ্ঠা হত কঠিন।

  • নবী ও রাসুলরা যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছেন — প্রতিটি যুগের মানুষের জন্য রিসালাত চালু ছিল।

  • ইসলামে বিশ্বাস রাখতে, রিসালাতকে মেনে নিতে হবে এবং নবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।


৮. রিসালাত অস্বীকারের ফল কী?

উত্তর:
রিসালাত অস্বীকার করা (অর্থাৎ নবী প্রেরণকে মানা না) কুফর (অবিশ্বাস) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এটি ঈমানের মুল ভিত্তির বিপরীত।


৯. শেষ নবী ও রিসালাত শেষ হওয়া—কথা কোথা থেকে?

উত্তর:
কুরআনে বলা হয়েছে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) “খাতামুন নবিউন” — নবীদের শেষ। (সুরা আল আhzাব ৩৩:৪۰)

إِنَّمَا أَنتَ مُنذِرٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُبَيِّنُ وَمَا تُخْفِي وَمَا تُنِيرُ
… وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكَ خَتَمَ النَّبِيِّينَ …
(আর এই রকমই আমরা তোমাকে নবীদের শেষ বানিয়েছি)

এই আয়াত দ্বারা নিহিত যে নতুন নবী বা রাসুল আর প্রেরণ হবে না। তাই রিসালাত ধারা শেষ হয়েছে।


১০. রিসালাতের প্রকারভেদ ও বিশ্লেষণ

উত্তর:
কিছু ইসলামিক চিন্তাবিদ রিসালাতকে ভাগ করেছেন — যেমন “সাধারণ রিসালাত” (যে সমস্ত নবী রিসালাত বহন করেছেন) এবং “বিশেষ রিসালাত” (নিয়ম, আইন বা শাসনব্যবস্থা প্রেরণযোগ্য বিশেষ রিসালাত)।
তবে প্রধান দিক থেকে রিসালাত সব নবীদের জন্য প্রযোজ্য।


১১. রিসালাত মানবসমাজের জন্য কেন জরুরি?

উত্তর:

  • মানুষ একদিক থেকে দৃষ্টিভ্রষ্ট; আল্লাহর নির্দেশ দরকার।

  • রিসালাত মানুষের মানসিক ও নৈতিক দিক গড়ে তোলে।

  • রিসালাত থাকলে মানুষ বোঝে তার ঈমান ও আচার-কর্মের মান।


১২. রিসালাত ও ওহীর সম্পর্ক

উত্তর:
ওহী — যেমন নবীর প্রতি প্রেরিত নির্দেশ (আল্লাহ থেকে সরাসরি বার্তা)।
রিসালাত — সেই ওহী গ্রহণ এবং মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া।


১৩. কোন নবী ও রাসুলদের নাম কুরআনে বর্ণিত আছে?

উত্তর:
কুরআনে মোট ২৫ জন নবী / রাসুলের নাম সরাসরি উল্লেখ আছে।
এদের মধ্যে হজ, ইব্রাহিম, নূহ, মূসা, ঈসা, মুহাম্মদ (ﷺ) ইত্যাদি।


১৪. রিসালাত ও নৈতিক চরিত্র — হাদিস অনুযায়ী

উত্তর:
নবী (ﷺ)-এর চরিত্র সর্বোচ্চ ছিলো। হাদিসে বলা হয়েছে:

“إِنَّما بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ”
(নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি মাকরমাতুল আখলাক, অর্থাৎ সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র সম্পন্ন করতে)
এই হাদিসটি বুখারি, মুসলিমে রয়েছে।

এই হাদিসের মানে হলো: রিসালাত শুধু আইন ও বিধান নয়, মহান চরিত্র গঠনও অন্তর্ভুক্ত।


১৫. রিসালাতের ধারাবাহিকতা — যুগে যুগে নবীদের প্রেরণ

উত্তর:
আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন — যেমন আদম, নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, ঈসা, ও শেষমেষ মুহাম্মদ (ﷺ)।
কুরআনে বলা হয়েছে:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ
(তোমার আগে আমরা কোনো নবী পাঠাইনি — বরং পুরুষকে প্রেরণ করেছি যাদের কাছে আমরা ওহী করি) — (সুরা আনম ৬:১)

এভাবে রিসালাত ধারাবাহিক ছিল।


১৬. রিসালাতের নামে ভুল ধারণা ও সংশোধন

উত্তর:
কিছু ভুল ধারণা, যেমন: রিসালাত শুধুমাত্র নবীদের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য; বা রিসালাত মানেই শুধুই আইনবিধান।
সত্য হলো: রিসালাত শুধুমাত্র আইন নয়, বরং শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আচার-আচরণসহ সব দিককে সমন্বিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব।


১৭. কুরআন ও নবী (ﷺ) সম্পর্কিত দলিল

উত্তর:
কুরআনে অনেক আয়াত আছে যেখানে মানুষকে বলা হয়েছে — “লুৎফاً ও রহমতে” (অনুগ্রহ ও মহিমায়) — এবং নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা ও দায়িত্বের উল্লেখ।
এছাড়া “কুরআন ও রাসূলকে মান্য করা” সর্বোচ্চ নির্দেশ হিসেবে উল্লেখ আছে যেমন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
(হে যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহর আল্লাহ ও রসূলকে আজ্ঞা করো) — (সুরা আনফাল ৮:২০)


১৮. রিসালাত ও “নামুসে রিসালাত” (রাসূলের মর্যাদা ও সন্মান) বিষয়

উত্তর:
নামুসে রিসালাত বলতে বোঝায় নবী (ﷺ)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকার। যারা নবীকে অবমাননা করে, ইসলামের মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে আসে।
একটি হাদিস নির্দেশ করে:

“لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين”
(তোমাদের কেউ পুরোপুরি ঈমান না আনবে যতক্ষণ আমি তার পরিবার, সন্তান ও সকল মানুষের তুলনায় তার কাছে প্রিয় না হই) — (সাহিহ বukhari)

এখানে নবী (ﷺ)-কে মানুষের হৃদয়ে সবার উপরে স্থান দেওয়া জরুরি।


১৯. রিসালাত সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করার পথ

উত্তর:

  • কুরআনের তাফসীর গ্রন্থ (যেমন আস-সাওয়াব, তাফসীর ইবনে কাসীর) পড়া,

  • হাদিস গ্রন্থ (বুখারি, মুসলিম, ইমাম বিন কুতুব, আহলো সুন্নাহ গ্রন্থ) বিশ্লেষণ করা,

  • আধ্যাত্মিক ও আকীদাগত গ্রন্থ ও গবেষণা অনুসন্ধান করা (যেমন دلائل النبوة / Dalail al-Nubuwwah)।

  • ইসলামিক শিক্ষাদান ও আলোচনা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া।


২০. সারাংশ ও দৃঢ় বিশ্বাসের আহ্বান

উত্তর:

  • রিসালাত হলো আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো।

  • এটি নবুওয়াতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্বন্ধযুক্ত।

  • কুরআন ও হাদিস দুই-ই রিসালাত ও নবীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মূল দলিল।

  • রিসালাত অস্বীকার করলে ঈমানের ভিত্তি কমজোর হবে।

  • তাই মানুষের জন্য জরুরি, রিসালাতের বিষয় বোঝা, গ্রহণ করা ও তার নির্দেশ অনুসরণ করা।

নিউজটি শেয়ার করুন

বিস্তারিত লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষণ করুন

ইসলামে রিসালাত (নবুয়ত) কী: অর্থ, গুরুত্ব ও কুরআন-হাদীসভিত্তিক ২০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

রিসালাত শব্দের অর্থ কি? রিসালাত কাকে বলে? ২০টি প্রশ্নোত্তর FAQ

আপডেট সময়ঃ ০৩:১৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

১. রিসালাত শব্দের অর্থ

  • “রিসালাত” (আরবি: الرّسالة / الرِّسَالَةُ) শব্দটি মূলত “প্রেরণ করা”, “পাঠানো” ইত্যাদি অর্থবহ ধাতু أ ر س لَ (अرسل) থেকে গঠিত।

  • আভিধানিক অর্থ হলো বার্তা বহন, সংবাদ পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি।

  • ইসলামী পরিভাষায় রিসালাত বলতে বোঝায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বাণী, নির্দেশ, আদেশ বা সত্য ধর্মীয় বার্তা যা নবী ও রাসুলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

  • সংক্ষেপে বলা যায়: রিসালাত = (আল্লাহর) বার্তা প্রেরণ + তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব


২. রিসালাত কাকে বলা হয়?

“রিসালাত” কার্যত সেই দায়িত্ব বা মাধ্যমকে বোঝায় যেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী ও নির্দেশ মানুষের কাছে পৌঁছায়। নিচে কিছু মূল দিক তুলে ধরা হলো:

বিষয় ব্যাখ্যা
রিসালাতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে ব্যক্তি আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়, তাঁকে রাসুল বা নবী বলা হয় (বিশেষ শর্ত থাকলে)।
নবী ও রাসুলের পার্থক্য প্রতিটি রাসুলই নবী হতে পারে। তবে প্রতিটি নবী রাসুল নয় — কারণ রাসুলগণ প্রায়ই নতুন আইন বা সর্বনবীকার্য সঙ্গে পাঠানো হয়।
রিসালাতের উদ্দেশ্য মানুষের হেদায়েত, সৎ পথ প্রদর্শন, আল্লাহর বিধান জানানো, মানুষের জীবনে ন্যায়-নৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
রিসালাত ও নবুওয়াত নবুওয়াত (নবীপ্রাপ্তি) রিসালাতের একটি রূপ—নবী ও রাসুলগণ ওহী দ্বারা বা আল্লাহর পক্ষ থেকে বাণী প্রাপ্ত হন এবং তা সম্প্রচার করেন।
রিসালাতের ধারাবাহিকতা আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন মানবজাতিকে প্রতি যুগে নির্দেশ ও দিশা প্রচারের জন্য।

উদাহরণ: কুরআনে আল্লাহ বলেন —
«فَبَشِّرْ عِبَادِيَ الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ»
অর্থ: “তাহলে আমার সেই বান্দাদেরকে সুখবস্তু দাও, যারা কথা শুনে (সত্যতা বিবেচনা করে) সর্বোৎকৃষ্ট অনুসরণ করে।” (সূরা আল-কাসাস ২৬:৫৭)
এখানে কথাটি — “কথা শোনা → সঠিক বাণী অনুসরণ” — রিসালাতের কার্যপ্রক্রিয়া নির্দেশ করে।

নিচে ২০টি প্রশ্ন‑উত্তর দিচ্ছি রিসালাত (রাসূল / নবীপ্রেরণা) বিষয়ে, এবং প্রতিটি উত্তরে কুরআনহাদিসের দলিল (যেখানে সম্ভব) সংযুক্ত করছি — যাতে বিষয়টা স্পষ্ট ও ভিত্তিসহ থাকে:


১. রিসালাত শব্দের অর্থ কী?

উত্তর:
“রিসালাত” (আরবি: الرِّسَالَة / الرِّسَالَةُ) নামক ধাতু أ ر س لَ (arsala — প্রেরণ করা) থেকে গঠিত। অর্থ হলো প্রেরণ করা, বার্তা পৌঁছানো। ইসলামী পরিভাষায় রিসালাত বোঝায় আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত বাণী বা নির্দেশ, যা নবী ও রাসুলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানো হয়


২. রিসালাত কাকে বলা হবে?

উত্তর:
যে ব্যক্তি — যে নবী বা রাসুল — আল্লাহর বাণী গ্রহণ করে (ওহী) এবং তা মানুষের কাছে প্রচার করে, তাঁকে রিসালাত বলার দায়িত্ব বা প্রক্রিয়া পালনকারী বলা যায়। অর্থাৎ, রিসালাত কেবল বার্তা নয়, সেই বার্তার গ্রহণ ও প্রচারের দায়িত্ব।


৩. রিসালাত ও নবুওয়াতের পার্থক্য কী?

উত্তর:

  • নবুওয়াত (নবীপ্রাপ্তি) হলো নবীর উদ্দেশ্যে ওহী বা ভবিষ্যদ্বাণী প্রাপ্তি।

  • রিসালাত হলো সেই প্রাপ্ত বাণীর প্রচার ও মানুষের কাছে পৌঁছানো।
    তাহলে বলা যেতে পারে: নবুওয়াত → রিসালাত।


৪. রিসালাতের উদ্দেশ্য কী?

উত্তর:
রিসালাত প্রেরণের উদ্দেশ্য হলো:

  • মানুষকে সঠিক পথ দেখানো,

  • আল্লাহর আদেশ ও বিধান জানানো,

  • ন্যায় ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা,

  • মানুষকে দায়বদ্ধ করা যে তারা ঈমানী ও কর্মনিষ্ঠ হোক।


৫. কুরআনে রিসালাতের প্রমাণ কোথায়?

উত্তর:
কুরআনে বহু স্থানেই বলা হয়েছে “আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি (أَرْسَلْنَا رُسُولًا…)” — অর্থ রিসালাত প্রেরণ।

উদাহরণস্বরূপ:

  • সুরা আল-বাকারাহ আয়াত ২৫৩:

    …وَرُسُلًا بَعْضَهُمْ مِنْ بَعْضٍ…
    (আমরা একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম…)

  • সুরা হজ আয়াত ৭৭:

    …وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا…
    (আমরা তোমাকে কেবল সকল মানুষের জন্য বাসীর ও নাজীর রূপে প্রেরণ করেছি)

এই ধরনের অনেক আয়াত আছে।


৬. হাদিসে রিসালাতের প্রমাণ কী?

উত্তর:
হাদিসগুলিতেও নবী (ﷺ)-কে রিসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে।

উদাহরণ:

  1. সাহিহ বুখারিসাহিহ মুসলিম-এ আছে:

    “إِنَّما بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ”
    (নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি স mooiste মর্যাদাপূর্ণ চরিত্রসমূহকে শেষ করতে) — অর্থ: একটা দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হওয়া, যা রিসালাতের সাথে সম্পর্কিত।

  2. আরও একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে নবী (ﷺ) বলেছিলেন:

    “خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ”
    (তোমাদের মধ্যে সেরা, যে কুরআন শিখে ও শিখায়) — এখানে রিসালাত ও শিক্ষা প্রচার সম্পর্কিত দায়িত্বের প্রতি ইঙ্গিত।

(উল্লেখ্য: এখানে হাদিসের বাংলা অনুবাদ এবং মূল বর্ণনা একসঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।)


৭. রিসালাতের গুরুত্ব ও অব্যাহতির দিক যুক্তি সহ

উত্তর:

  • রিসালাত ঈমানের একটি মৌলধারার অংশ।

  • যদি রিসালাত বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে মানুষ আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ পেত না, ধর্ম প্রতিষ্ঠা হত কঠিন।

  • নবী ও রাসুলরা যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছেন — প্রতিটি যুগের মানুষের জন্য রিসালাত চালু ছিল।

  • ইসলামে বিশ্বাস রাখতে, রিসালাতকে মেনে নিতে হবে এবং নবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।


৮. রিসালাত অস্বীকারের ফল কী?

উত্তর:
রিসালাত অস্বীকার করা (অর্থাৎ নবী প্রেরণকে মানা না) কুফর (অবিশ্বাস) হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এটি ঈমানের মুল ভিত্তির বিপরীত।


৯. শেষ নবী ও রিসালাত শেষ হওয়া—কথা কোথা থেকে?

উত্তর:
কুরআনে বলা হয়েছে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) “খাতামুন নবিউন” — নবীদের শেষ। (সুরা আল আhzাব ৩৩:৪۰)

إِنَّمَا أَنتَ مُنذِرٌ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تُبَيِّنُ وَمَا تُخْفِي وَمَا تُنِيرُ
… وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكَ خَتَمَ النَّبِيِّينَ …
(আর এই রকমই আমরা তোমাকে নবীদের শেষ বানিয়েছি)

এই আয়াত দ্বারা নিহিত যে নতুন নবী বা রাসুল আর প্রেরণ হবে না। তাই রিসালাত ধারা শেষ হয়েছে।


১০. রিসালাতের প্রকারভেদ ও বিশ্লেষণ

উত্তর:
কিছু ইসলামিক চিন্তাবিদ রিসালাতকে ভাগ করেছেন — যেমন “সাধারণ রিসালাত” (যে সমস্ত নবী রিসালাত বহন করেছেন) এবং “বিশেষ রিসালাত” (নিয়ম, আইন বা শাসনব্যবস্থা প্রেরণযোগ্য বিশেষ রিসালাত)।
তবে প্রধান দিক থেকে রিসালাত সব নবীদের জন্য প্রযোজ্য।


১১. রিসালাত মানবসমাজের জন্য কেন জরুরি?

উত্তর:

  • মানুষ একদিক থেকে দৃষ্টিভ্রষ্ট; আল্লাহর নির্দেশ দরকার।

  • রিসালাত মানুষের মানসিক ও নৈতিক দিক গড়ে তোলে।

  • রিসালাত থাকলে মানুষ বোঝে তার ঈমান ও আচার-কর্মের মান।


১২. রিসালাত ও ওহীর সম্পর্ক

উত্তর:
ওহী — যেমন নবীর প্রতি প্রেরিত নির্দেশ (আল্লাহ থেকে সরাসরি বার্তা)।
রিসালাত — সেই ওহী গ্রহণ এবং মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া।


১৩. কোন নবী ও রাসুলদের নাম কুরআনে বর্ণিত আছে?

উত্তর:
কুরআনে মোট ২৫ জন নবী / রাসুলের নাম সরাসরি উল্লেখ আছে।
এদের মধ্যে হজ, ইব্রাহিম, নূহ, মূসা, ঈসা, মুহাম্মদ (ﷺ) ইত্যাদি।


১৪. রিসালাত ও নৈতিক চরিত্র — হাদিস অনুযায়ী

উত্তর:
নবী (ﷺ)-এর চরিত্র সর্বোচ্চ ছিলো। হাদিসে বলা হয়েছে:

“إِنَّما بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الْأَخْلَاقِ”
(নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি মাকরমাতুল আখলাক, অর্থাৎ সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্র সম্পন্ন করতে)
এই হাদিসটি বুখারি, মুসলিমে রয়েছে।

এই হাদিসের মানে হলো: রিসালাত শুধু আইন ও বিধান নয়, মহান চরিত্র গঠনও অন্তর্ভুক্ত।


১৫. রিসালাতের ধারাবাহিকতা — যুগে যুগে নবীদের প্রেরণ

উত্তর:
আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন — যেমন আদম, নূহ, ইব্রাহিম, মূসা, ঈসা, ও শেষমেষ মুহাম্মদ (ﷺ)।
কুরআনে বলা হয়েছে:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُوحِي إِلَيْهِمْ
(তোমার আগে আমরা কোনো নবী পাঠাইনি — বরং পুরুষকে প্রেরণ করেছি যাদের কাছে আমরা ওহী করি) — (সুরা আনম ৬:১)

এভাবে রিসালাত ধারাবাহিক ছিল।


১৬. রিসালাতের নামে ভুল ধারণা ও সংশোধন

উত্তর:
কিছু ভুল ধারণা, যেমন: রিসালাত শুধুমাত্র নবীদের অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য; বা রিসালাত মানেই শুধুই আইনবিধান।
সত্য হলো: রিসালাত শুধুমাত্র আইন নয়, বরং শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আচার-আচরণসহ সব দিককে সমন্বিতভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব।


১৭. কুরআন ও নবী (ﷺ) সম্পর্কিত দলিল

উত্তর:
কুরআনে অনেক আয়াত আছে যেখানে মানুষকে বলা হয়েছে — “লুৎফاً ও রহমতে” (অনুগ্রহ ও মহিমায়) — এবং নবী (ﷺ)-এর মর্যাদা ও দায়িত্বের উল্লেখ।
এছাড়া “কুরআন ও রাসূলকে মান্য করা” সর্বোচ্চ নির্দেশ হিসেবে উল্লেখ আছে যেমন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
(হে যারা ঈমান এনেছো! আল্লাহর আল্লাহ ও রসূলকে আজ্ঞা করো) — (সুরা আনফাল ৮:২০)


১৮. রিসালাত ও “নামুসে রিসালাত” (রাসূলের মর্যাদা ও সন্মান) বিষয়

উত্তর:
নামুসে রিসালাত বলতে বোঝায় নবী (ﷺ)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকার। যারা নবীকে অবমাননা করে, ইসলামের মূল বিশ্বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে আসে।
একটি হাদিস নির্দেশ করে:

“لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين”
(তোমাদের কেউ পুরোপুরি ঈমান না আনবে যতক্ষণ আমি তার পরিবার, সন্তান ও সকল মানুষের তুলনায় তার কাছে প্রিয় না হই) — (সাহিহ বukhari)

এখানে নবী (ﷺ)-কে মানুষের হৃদয়ে সবার উপরে স্থান দেওয়া জরুরি।


১৯. রিসালাত সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধান করার পথ

উত্তর:

  • কুরআনের তাফসীর গ্রন্থ (যেমন আস-সাওয়াব, তাফসীর ইবনে কাসীর) পড়া,

  • হাদিস গ্রন্থ (বুখারি, মুসলিম, ইমাম বিন কুতুব, আহলো সুন্নাহ গ্রন্থ) বিশ্লেষণ করা,

  • আধ্যাত্মিক ও আকীদাগত গ্রন্থ ও গবেষণা অনুসন্ধান করা (যেমন دلائل النبوة / Dalail al-Nubuwwah)।

  • ইসলামিক শিক্ষাদান ও আলোচনা কার্যক্রমে যুক্ত হওয়া।


২০. সারাংশ ও দৃঢ় বিশ্বাসের আহ্বান

উত্তর:

  • রিসালাত হলো আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো।

  • এটি নবুওয়াতের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্বন্ধযুক্ত।

  • কুরআন ও হাদিস দুই-ই রিসালাত ও নবীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মূল দলিল।

  • রিসালাত অস্বীকার করলে ঈমানের ভিত্তি কমজোর হবে।

  • তাই মানুষের জন্য জরুরি, রিসালাতের বিষয় বোঝা, গ্রহণ করা ও তার নির্দেশ অনুসরণ করা।