হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও পদ্ধতি
হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও পদ্ধতি

- আপডেট সময়ঃ ১১:৩৯:৪০ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ৪৫ বার পড়া হয়েছে।
হজ ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ। এটি শারীরিক, আর্থিক ও আত্মিক ইবাদতের এক অনন্য মিশ্রণ। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। হজ হলো এমন একটি ইবাদত, যার মাধ্যমে মানুষ পূর্বের সকল গুনাহ থেকে মুক্তি পেয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারে।
এই প্রবন্ধে আমরা হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও পদ্ধতি দলীলসহ আলোচনা করবো।
হজের সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
হজ শব্দের অর্থ: কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছা ও সংকল্পসহ সফর করা।
শরীয়তের পরিভাষায়: নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট কার্যাবলি পালন করাকে হজ বলে।আল্লাহ বলেন:“এবং মানুষের মধ্যে যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে কা’বা গৃহে হজ করা তাদের ওপর ফরজ।”— (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭)
🔹 রাসূল ﷺ বলেন:“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও হজ করলো না, সে ইচ্ছা করলে ইহুদি হয়ে মরুক অথবা খ্রিষ্টান হয়ে।”— (তিরমিজি: ৮১২, হাদীসটি হাসান)
হজের শ্রেণিবিন্যাস
হজ তিনভাবে আদায় করা যায়:
- হজ তামাত্তু – উমরাহ করে হজ করা
- হজ কিরান – উমরাহ ও হজ এক ইহরামে
- হজ ইফরাদ – শুধু হজ
হজের ফরজ (৩টি)
হজে তিনটি কাজ ফরজ। এর যেকোনো একটি ছুটে গেলে হজ শুদ্ধ হবে না:
- ইহরাম বাঁধা – হজের নিয়তের মাধ্যমে ইহরাম গ্রহণ
- আরাফায় অবস্থান – ৯ জিলহজ দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত
- তাওয়াফে যিয়ারাহ – কুরবানির পর কা’বার তাওয়াফ
রাসূল ﷺ বলেন:
“হজ হচ্ছে আরাফা।”
— (তিরমিজি: ৮৮৯)
হজের ওয়াজিব (৭টি বা অধিকাংশ ফকিহদের মতে ৮টি)
ওয়াজিব কাজ না করলে হজ আদায় হবে তবে দম (কুরবানি) দিতে হবে।
- মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা
- মুজদালিফায় রাত যাপন
- শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ (রমী জামারাত)
- কুরবানি করা (তামাত্তু ও কিরানের জন্য)
- সাঈ (সফা-মারওয়ার মধ্যে দৌড়)
- মিনায় তিন রাত অবস্থান (১১, ১২, ১৩ জিলহজ)
- চুল কাটানো বা ছাঁটা (হালক বা কসর)
- তাওয়াফে বিদা (বিদায়ী তাওয়াফ) – (মুকিমদের জন্য ফরজ, মুসাফিরদের জন্য ওয়াজিব)
হাদীস:
“হজের যে কেউ কিছু বাদ দিয়েছে, সে যেন কুরবানি দেয়।”
— (বুখারী ও মুসলিম)
হজের সুন্নাতসমূহ
- ইহরাম পরার আগে গোসল করা
- সুগন্ধি ব্যবহার (পুরুষদের জন্য)
- দুই রাকাত নফল সালাত ইহরামের পর
- তলবিয়া পড়া:
“لَبَّيْكَ اللّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ…”
- হজের আমলসমূহ ক্রমানুসারে আদায় করা
- কা’বা শরীফ দেখার সময় তাকবির, দোয়া করা
- তাওয়াফে কাবার সময় রমল (দৌড়ের মতো হাঁটা) করা
- সাঈ করার সময় দৌড়ানো (সবুজ বাতির মধ্য দিয়ে পুরুষদের জন্য)
হজের সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি
প্রথম দিন – ৮ জিলহজ (ইয়াওমুত তারওয়িয়া)
- ইহরাম বাঁধা ও হজের নিয়ত
- মিনায় গমন, ৫ ওয়াক্ত নামায
- রাতে মিনায় অবস্থান
দ্বিতীয় দিন – ৯ জি ; (ই-য়াওমে আরাফা)
- ফজরের নামায মিনায়
- সূর্যোদয়ের পর আরাফার ময়দানে গমন
- জোহরের পর খুতবা ও সালাত জামাতে আদায়
- মাগরিব নামায না পড়ে মুজদালিফায় যাত্রা
৩য় – ১০ জিল ; (ইয়াও-মুন নাহর/কুরবানির দিন)
- ফজরের নামায মুজদালিফায়
- সূর্য ওঠার পর জামারাতুল উকবা (বড় শয়তান) রমী
- কুরবানি
- চুল কাটা বা ছাঁটা
- ইহরাম খোলা (হালাল হওয়া)
- তাওয়াফে জিয়ারাহ
- রাতে মিনায় যাপন
৪র্থ ও ৫ম – ১১ ও ১২ জিলহ-জ
- তিনটি জামারাতে রমী (প্রত্যেকটিতে ৭টি কঙ্কর)
- রাতে মিনায় অবস্থান
- ১২ তারিখে বিদায় চাইলে মিনা ত্যাগ, নইলে ১৩ তারিখেও রমী
বিদায়ী তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা)
- দেশে ফেরার আগে বিদায়ী তাওয়াফ ফরজ (মুকিমদের জন্য)
নারীদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা
- ইহরামের জন্য তাদের নির্দিষ্ট পোশাক নেই, যে কোনো ঢিলেঢালা ও পর্দাসম্মত পোশাকই যথেষ্ট
- নারীরা রমলে অংশ নেয় না, কাঁধ খোলা রাখে না
- তাদের জন্য একাকী হজ করা বৈধ নয়, মাহরাম থাকা আবশ্যক
রাসূল ﷺ বলেন:
“নারী যেন মাহরাম ছাড়া সফরে না যায়।”
— (বুখারী, হাদীস: ৩০০৬)
হজ না করলে গুনাহ
আল্লাহ বলেন:
“যে ব্যক্তি হজ ফরজ হওয়ার পর তা করে না, সে কাফেরের ন্যায় গোনাহে লিপ্ত।”
— (আলে ইমরান: ৯৭ ব্যাখ্যা, তাফসীর ইবনে কাসীর)
হজ শুধুমাত্র শরীরের কষ্ট ও আর্থিক ব্যয় নয়, এটি আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ সুযোগ। হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত ও পদ্ধতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে ইবাদতটি সঠিকভাবে আদায় করা সম্ভব হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ নিশ্চিত হয়।
আমরা যেন যথাযথভাবে হজ আদায় করতে পারি এবং আল্লাহর অতিথি হয়ে জান্নাতের মেহমান হই— এই দোয়া রইল।
📚 তথ্যসূত্র:
- কুরআন মাজিদ – সূরা আলে ইমরান (৩:৯৭)
- সহীহ বুখারী – হাদীস: ৩০০৬, ১৫২১
- সহীহ মুসলিম – হাদীস: ১৩৫০
- তিরমিজি – হাদীস: ৮১২, ৮৮৯
- ফিকহুস সুন্নাহ – সাইয়্যিদ সাবিক
- হিদায়াহ ও তাফসীর ইবনে কাসীর
- আল-মুগনি – ইমাম ইবনে কুদামাহ