মক্কা শরীফ ও কাবা ঘরের মর্যাদা ও ফজিলত
মক্কা শরীফ ও কাবা ঘরের মর্যাদা ও ফজিলত

- আপডেট সময়ঃ ১০:১১:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ২৪ বার পড়া হয়েছে।
আরব উপদ্বীপের এক মরু শহর, মক্কা আল-মুকাররমা, ইসলামের পবিত্রতম নগরী। এর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত কা‘বা শরীফ, যা বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু। মক্কা শরীফ কেবল একটি শহর নয়—বরং এটি ঈমান, ঐক্য, ও আত্মিক সম্পর্কের প্রতীক। ইসলামী আকীদা ও ইতিহাসে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন, হাদীস ও ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে মক্কা ও কা‘বা শরীফের মর্যাদা ও ফজিলত আলোচনা করবো।
১. কুরআনের আলোকে মক্কার মর্যাদা
আল্লাহ তাআলা বহু আয়াতে মক্কার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য বর্ণনা করেছেন।“নিশ্চয়ই মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর স্থাপিত হয়েছে, তা ছিল বাক্কায় (মক্কা), যা বরকতময় এবং সমগ্র জাহানের জন্য হেদায়াত।”— (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৬) এই আয়াতে কা‘বা শরীফকে “বরকতময়” এবং “হিদায়াতের উৎস” বলা হয়েছে। এটিই মানবজাতির জন্য নির্মিত প্রথম ইবাদতের ঘর।
🔹“আমি শপথ করছি এই নগরীর (মক্কার),”— (সূরা আল-বালাদ, ৯০:১) আল্লাহ নিজেই মক্কার নামে শপথ করেছেন, যা এর অতুলনীয় মর্যাদার দলীল।
🔹 “আল্লাহ কা‘বা, পবিত্র ঘরটিকে মানুষের জন্য কায়েম থাকার মাধ্যম করেছেন।”— (সূরা আল-মায়েদা, ৫:৯৭) কা‘বা শরীফ হচ্ছে ইসলামী একত্ববাদের কেন্দ্র—আত্মিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল উৎস।
২. রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর দৃষ্টিতে মক্কার সম্মান –
রাসূলুল্লাহ ﷺ মক্কার প্রতি তাঁর ভালবাসা ও মর্যাদা সম্পর্কে বলেন:
“আল্লাহর কসম! তুমি (মক্কা) আল্লাহর সবচেয়ে উত্তম ভূমি এবং আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় ভূমি। যদি আমাকে এখান থেকে বের করে না দেওয়া হতো, তবে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”— (তিরমিজি, হাদীস ৩৯২৫) এই হাদীস প্রমাণ করে, মক্কা হচ্ছে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় শহর।
৩. কা‘বা শরীফ: আল্লাহর ঘর
কা‘বা শরীফ প্রথম নির্মাণ করেন ইব্রাহীম (আঃ) ও ইসমাঈল (আঃ) “স্মরণ করো, যখন আমি ইব্রাহীমকে ঘর নির্মাণের স্থান নির্ধারণ করে বললাম: আমার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, এবং আমার ঘরকে পবিত্র রাখো তাওয়াফকারীদের জন্য…”— (সূরা হজ, ২২:২৬) এটি শুধুমাত্র একটি ভবন নয়, বরং এটি আল্লাহর ঘর—পবিত্রতা, একত্ববাদ ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক।
৪. মুসলিম ঐক্যের কেন্দ্র
প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে সারা বিশ্বের মুসলিমরা ইবাদত করে থাকেন।“তুমি তোমার মুখ মুড়িয়ে পবিত্র মসজিদের দিকে করো। এবং যেখানেই থাকো, তোমরা তোমাদের মুখ সেই দিকেই করো।”— (সূরা বাকারা, ২:১৪৪) কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ আদায় করা মুসলিমদের মধ্যে আত্মিক ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।
৫. মক্কায় আমলের ফজিলত
মক্কা শরীফে একটি নামাজ অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে বহু গুণ বেশি সাওয়াবযুক্ত।“আমার এই মসজিদে (মদিনা) এক নামাজ, অন্যান্য মসজিদের তুলনায় এক হাজার নামাজের চেয়ে উত্তম; কিন্তু মসজিদে হারামে এক নামাজ এক লক্ষ নামাজের সমান।”— (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস ১৪৬৯৪) এক নামাজেই এক লক্ষ নামাজের সাওয়াব! এটি কা‘বার ফজিলতের বড় দলীল।
৬. মক্কা: নিরাপত্তা ও শান্তির নগরী
“আর যে কেউ এতে (হারামে) প্রবেশ করলো, সে নিরাপত্তা লাভ করলো।”— (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭) হারাম শরীফে প্রবেশকারী সকলের জন্য নিরাপত্তা ও শান্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম সেখানে যুদ্ধ, রক্তপাত, পশু হত্যা, গাছ কাটা নিষিদ্ধ করেছে।
“আল্লাহ এই শহরকে পবিত্র করেছেন যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্রই থাকবে।”— (বুখারী, হাদীস ১০৪)
৭. হজ ও উমরাহর কেন্দ্রবিন্দু
“মানুষের উপর আল্লাহর জন্য হজ্ব করা ফরজ, যদি কেউ সামর্থ্য রাখে।”— (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯৭)
🔹 হজ্ব ও উমরাহ—উভয়ই কা‘বার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। হজ্বের প্রতিটি রুকন—তাওয়াফ, সাঈ, আরাফাতে অবস্থান, কুরবানী—সবই কা‘বাকেন্দ্রিক।“এক উমরাহ থেকে আরেক উমরাহ—দুইয়ের মাঝে গুনাহ মোচন হয়। এবং হজ্বে মাবরুরের পুরস্কার শুধুই জান্নাত।”— (বুখারী, হাদীস ১৭৭৩)
৮. ভবিষ্যৎকালীন গুরুত্ব (ইস্লামি ইসকাতোলজি)
- কিয়ামতের আগে ইমাম মাহদি কা‘বা শরীফের নিকটে বায়াত গ্রহণ করবেন।
- ঈসা (আঃ) দুনিয়ায় অবতরণ করে হজ্ব বা উমরাহ পালন করবেন—এমন বর্ণনা হাদীসে রয়েছে।
৯. মক্কা সফরের আদব ও নিয়মাবলী
- ইখলাস ও খুশু সহকারে প্রবেশ করা
- উচ্চ স্বরে কথা না বলা
- গুনাহ ও গাফিলতা থেকে দূরে থাকা
- কা‘বা শরীফকে সম্মানের চোখে দেখা
- বেশি বেশি তাওয়াফ, দোয়া, তাওবা ও ইবাদত করা
মক্কা আল-মুকাররমা ও কা‘বা শরীফ শুধুমাত্র ঐতিহাসিক স্থান নয়—এগুলো ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। এদের মর্যাদা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, রাসূল ﷺ-এর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, সাহাবাদের দ্বারা অনুসৃত, এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে মক্কার প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ থাকা ঈমানের লক্ষণ।
এই ভূমির মর্যাদা মানা, সংরক্ষণ করা, এবং সেখানে গুনাহ থেকে বিরত থাকা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব।
উল্লেখযোগ্য সূত্রসমূহ
- কুরআন: সূরা আলে ইমরান (৩:৯৬–৯৭), সূরা বাকারা (২:১৪৪), সূরা আল-মায়েদা (৫:৯৭), সূরা হজ (২২:২৬)
- সহীহ বুখারী: হাদীস ১০৪, ১৭৭৩
- তিরমিজি: হাদীস ৩৯২৫
- মুসনাদ আহমাদ: হাদীস ১৪৬৯৪
- তাফসীর ইবনে কাসীর ও তাফসীর কুরতুবী
- রিয়াদুস সালিহীন – ইমাম নববী