হজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: কুরআন ও হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণ
হজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: কুরআন ও হাদীসভিত্তিক বিশ্লেষণ

- আপডেট সময়ঃ ১১:৫৩:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
- / ৪৩ বার পড়া হয়েছে।
ইসলামে হজ একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। মুসলমানদের জন্য এটি এক মহিমান্বিত সফর, যা আল্লাহর ঘর — কা‘বা শরীফ — কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। তবে হজ শুধু একটি আচার নয়; এটি ইতিহাস, নবুওয়াত, আত্মশুদ্ধি এবং ঈমানের নিদর্শন বহন করে।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব, কীভাবে হজের সূচনা হয়, কিভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কিভাবে তা চূড়ান্তরূপ লাভ করে ইসলামে।
১. হজের আদি ইতিহাস: আদম (আ.) ও কা‘বার প্রথম নির্মাণ
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, সর্বপ্রথম কা‘বা নির্মাণ করেন আদম (আ.)। তখন থেকেই এটি ছিল আল্লাহর ইবাদতের কেন্দ্র।কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:“নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, তা হলো মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় ও সারা জাহানের জন্য পথনির্দেশ।”— [সূরা আলে ইমরান ৩:৯৬]
তবে কালের বিবর্তনে কা‘বা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) একে পুনর্নির্মাণ করেন।
২. ইব্রাহিম (আ.) ও হজের পুনঃস্থাপন
ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। তিনিই আল্লাহর হুকুমে কা‘বা পুনর্নির্মাণ করেন এবং মানুষকে হজের জন্য আহ্বান জানান।“যখন আমি ইব্রাহিমের জন্য কা‘বার স্থান নির্ধারণ করলাম… এবং মানুষের মধ্যে হজের আহ্বান করে দাও…”— [সূরা হজ ২২:২৬-২৭]
🔸 হাদীসে এসেছে, ইব্রাহিম (আ.) পাহাড়ের ওপর উঠে আহ্বান করেন, আর আল্লাহ সেই ডাক পৃথিবীর সমস্ত মানুষের আত্মার মধ্যে পৌঁছে দেন। যারা উত্তর দিয়েছিল, তারা হজে আসবে।
৩. হাজেরা (আ.) ও সাঈর ইতিহাস
ইব্রাহিম (আ.)-এর স্ত্রী হাজেরা (আ.) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.) যখন মক্কায় একাকী ছিলেন, তখন পানির খোঁজে হাজেরা (আ.) দুই পাহাড় — সফা ও মারওয়া — এর মাঝে সাতবার দৌড়ান। এ ঘটনাকে স্মরণ করেই সাঈ করা হয়।
“নিশ্চয়ই সফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।”— [সূরা বাকারা ২:১৫৮]
৪. কুরবানি ও শয়তানকে পাথর নিক্ষেপের ইতিহাস
ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে স্বপ্নে পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হন। আল্লাহ তাঁর পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে একটি পশু পাঠান।এই ঘটনা থেকেই হজে কুরবানির রীতি এসেছে।তিনটি স্থানে শয়তান তাঁকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল — তাই সেই স্থানে রমী জামারাত (পাথর নিক্ষেপ) করা হয়।
৫. জাহিলিয়াত যুগে হজের বিকৃতি
ইব্রাহিমি হজ সময়ের সাথে সাথে বিকৃত হতে থাকে। কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্র হজকে ব্যবসা ও কুসংস্কারের কেন্দ্রে পরিণত করে।
- মূর্তিপূজা
- নগ্ন তাওয়াফ
- কবিতা আবৃত্তি
- হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করা
“তারা কা‘বা ঘরের চারপাশে নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করত।”
— [সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৫১৯]
৬. ইসলামে হজ ফরজ হওয়া ও পরিপূর্ণতা লাভ
➤ হিজরি ৯ম সনে হজ ফরজ হয়:
“আর মানুষের মধ্যে যারা সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য কা‘বার হজ ফরজ।”
— [সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭]
রাসূল ﷺ ৯ম হিজরিতে হজ করেননি, বরং আবু বকর (রা.)-কে আমির বানিয়ে পাঠান। এবং পরের বছর, ১০ হিজরিতে নিজে হজ আদায় করেন, যা হজ্বাতুল বিদা নামে পরিচিত।
৭. রাসূল ﷺ এর হজ: হজ্বাতুল বিদা
- প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার সাহাবী হজে অংশগ্রহণ করেন
- নবীজি ﷺ আরাফার ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন
- ভাষণে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, সুদের নিষেধাজ্ঞা, মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বের আহ্বান ছিল
- এই সময় নাজিল হয়:
“আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম…”
— [সূরা মায়িদা ৫:৩]
৮. হজের রীতিনীতির প্রতিটি স্তর ইব্রাহিমি ঐতিহ্যবাহী
রীতি | উৎস | ইতিহাস |
---|---|---|
তাওয়াফ | কা‘বা | আদম ও ইব্রাহিম (আ.) |
সাঈ | সফা-মারওয়া | হাজেরা (আ.) |
কুরবানি | মিনায় | ইব্রাহিম (আ.) |
আরাফা | আরাফার ময়দান | ইব্রাহিম (আ.) |
রমী জামারাত | মিনার শয়তান | ইব্রাহিম (আ.) |
৯. হজের মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
হজ শুধুই ভ্রমণ নয়, বরং:
- আত্মশুদ্ধি
- তাওহীদের ঘোষণা
- তাকওয়া অর্জন
- উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি
“যে ব্যক্তি রিয়া বা পাপছাড়া হজ করে, সে ফিরে আসে যেন নবজাতক শিশুর মতো পাপমুক্ত হয়ে।”
— [সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৫২১]
১০. বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের মঞ্চ: হজ
হজে কোনো জাতিগত, বর্ণগত, অর্থনৈতিক ভেদাভেদ নেই। সবার পোশাক ইহরাম — সবাই আল্লাহর দাস।
“হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি…”
— [সূরা হুজুরাত ৪৯:১৩]
হজের ইতিহাস কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয়; এটি তাওহীদের উত্তরাধিকার, নবীদের আত্মত্যাগের স্মৃতি, এবং বিশ্ব মুসলিমদের একতাবদ্ধ হবার বার্তা বহন করে। হজের প্রতিটি রুকন এক একটি নিদর্শন — আত্মত্যাগ, ধৈর্য, আনুগত্য এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার।
ইসলামে হজের সূচনা হয় ইব্রাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে এবং পূর্ণতা লাভ করে রাসূলুল্লাহ ﷺ- এর মাধ্যমে। সেই ঐতিহ্য আজও বহমান বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে।
📚 তথ্যসূত্র
- কুরআন মাজিদ – সূরা হজ (২২:২৬-২৭), সূরা আলে ইমরান (৩:৯৬-৯৭), সূরা মায়িদা (৫:৩), সূরা বাকারা (২:১২৭, ১৫৮)
- সহীহ বুখারী – হাদীস: ১৫১৯, ১৫২১
- সহীহ মুসলিম – হাদীস: ১২১৮
- সীরাত ইবনে হিশাম
- আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবনে কাসীর
- তাফসীর ইবনে কাসীর ও কুরতুবী
- ফিকহুস সিরাহ – আল বুতি