কুরবানী না করেও সাওয়াব
কে কুরবানী না করেও সাওয়াব পাবে? – ইসলামিক বিশ্লেষণ

- আপডেট সময়ঃ ১১:৪৮:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
- / ৪২ বার পড়া হয়েছে।

কার উপর কুরবানী ওয়াজিব এবং কেমন পশু কুরবানীর জন্য কুরবানীর পশুর কি কি খাওয়া হারামউত্তম কে কুরবানী না করেও সাওয়াব পাবে?
কুরবানী হলো ইসলামে এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এই ইবাদত হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) এর স্মৃতিচারণ ও আল্লাহর প্রতি ত্যাগের নিদর্শন। তবে অনেকেই প্রশ্ন করেন—যারা কুরবানী দিতে সক্ষম নন বা কোনো কারণে কুরবানী করতে পারলেন না, তারা কি সাওয়াব পাবেন?
এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন, হাদীস ও ফিকহের আলোকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখব: “কে কুরবানী না করেও সাওয়াব পেতে পারেন?”
কুরবানীর ফজিলত ও গুরুত্ব
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং কুরবানী দাও।”
— (সূরা কাওসার: ২)
রাসূল ﷺ বলেন:
“কেয়ামতের দিন কুরবানীর পশু তার শিং, খুর ও পশমসহ আসবে। রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়।”
— (তিরমিযী: ১৪৯৩)
কুরবানী কার উপর ওয়াজিব?
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সহ অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম বলেন—
ওয়াজিব হয় এই শর্তে:
-
মুসলিম হতে হবে
-
বালেগ হতে হবে
-
মুক্ত হতে হবে
-
স্থানীয় (মুসাফির না)
-
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে (সোনা ৭.৫ তোলা বা রূপা ৫২.৫ তোলা, বা সমমূল্য সম্পদ)
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।”
— (ইবন মাজাহ: ৩১২৩)
তবে কারা কুরবানী না করেও সাওয়াব পেতে পারেন?
১. ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অক্ষম ব্যক্তি
যাদের অন্তরে কুরবানীর তীব্র ইচ্ছা থাকে, কিন্তু অর্থ বা সম্পদের অভাবে তা করতে পারেন না—তারা নিয়তের ভিত্তিতে সাওয়াব পেতে পারেন।
“নিশ্চয়ই আমলের মান নির্ভর করে নিয়তের উপর।”
— (সহীহ বুখারী: ১, সহীহ মুসলিম: ১৯০৭)
💡 উদাহরণ:
একজন গরীব মুসলিম, যিনি গরু কিনে কুরবানী দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেননি, তাঁর নিয়তের কারণে আল্লাহ তাঁর জন্য পূর্ণ সাওয়াব লিখে দেবেন।
২. অন্যের পক্ষ থেকে কুরবানী হলে
কেউ যদি তার মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান বা মৃত আত্মীয়ের পক্ষ থেকে কুরবানী করে, তবে যার পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়, তিনিও সাওয়াব পান।
রাসূল ﷺ নিজেও কুরবানীর সময় বলেন:
“হে আল্লাহ! এটি আমার পক্ষ থেকে ও আমার পরিবার থেকে।”
— (সুনান আবু দাউদ: ২৮১০)
মৃত ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় কুরবানীর ইচ্ছা পোষণ করে থাকলে এবং তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়, তাহলে তিনি সাওয়াব পান ইনশাআল্লাহ।
৩. ছোট শিশু ও গরীব যাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়
শিশু, দরিদ্র, দেনায় জর্জরিত ব্যক্তি, বা মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে তারা কুরবানীর দিনে অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে (যেমন রোযা, যিকর, সালাত) আল্লাহর কাছ থেকে ফজিলত ও সাওয়াব অর্জন করতে পারে।
৪. আশুরার দিন বা আরাফার দিন রোযা রাখা
যারা কুরবানী দিতে পারছেন না, তারা আরাফার দিনে রোযা রেখে অনেক ফজিলত লাভ করতে পারেন।
রাসূল ﷺ বলেন:
“আরাফার দিনের রোযা গত বছর ও আগামী বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়।”
— (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. অন্য ইবাদতের মাধ্যমে সাওয়াব অর্জন
কুরবানী করতে না পারলেও ঈদের দিন:
-
তাকবীর বলা (তাকবীরে তাশরিক)
-
ঈদের নামায আদায়
-
যাকাত, দান-সদকা করা
-
পরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে অনেক সাওয়াব অর্জন করা সম্ভব।
নিয়ত – সাওয়াবের মূল চাবিকাঠি
যেকোনো ইবাদতে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। যদি কেউ অর্থের অভাবে কুরবানী না করতে পারেন, তবে:
“যদি কোন বান্দা নিয়ত করে যে, আমি আল্লাহর জন্য কুরবানী করবো, এবং সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি—আল্লাহ তাঁর পূর্ণ সাওয়াব লিখে দেন।”
— (ইবন রজব হাম্বলি, লাতায়িফুল মা’আরিফ)
ফাজিলতপূর্ণ বিকল্প ইবাদত
১. ঈদের দিন কুরআন তিলাওয়াত ও যিকর
তাকবীর বলা, ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ বলা অত্যন্ত সাওয়াবের কাজ।
২. গরীবদের খাবার খাওয়ানো
যদি কেউ কুরবানী না করতে পারেন, তবে ঈদের দিন গরীবদের আহার করানোও একটি ফজিলতপূর্ণ কাজ।
“যে ব্যক্তি কোন গরীবকে খাদ্য দিল, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন।”
— (তিরমিযী: ১৮৭৭)
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা – বাধা নয় নিয়তে
আল্লাহ কারো সাধ্যের বাইরে তাকলীফ দেন না। কুরআনে বলা হয়েছে:
“আল্লাহ কারো উপর তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব চাপান না।”
— (সূরা বাকারা: ২৮৬)
তাই যাঁরা আর্থিক কারণে কুরবানী করতে পারছেন না, তাঁরা দুশ্চিন্তা না করে ভালো নিয়ত রাখুন এবং যত ইবাদত সম্ভব, তা করে যান।
কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, কিন্তু এটি শুধুমাত্র সামর্থ্যবানদের উপর ওয়াজিব। যারা নিরুপায়, গরীব বা কোনো কারণে কুরবানী করতে পারেন না, অথচ তাদের অন্তরে রয়েছে কুরবানীর গভীর ইচ্ছা ও নিয়ত—তারা ইনশাআল্লাহ পূর্ণ সাওয়াব পেতে পারেন।
এছাড়াও, অন্য ইবাদত ও সদকা দ্বারা তাঁরা কুরবানীর সময়ের ফজিলত ও নেকি অর্জন করতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়ত সহ ইবাদত করার তাওফিক দিন।
প্রশ্নোত্তর (FAQs)
১. কুরবানী না করেও কেউ কি ঈদের সওয়াব পেতে পারে?
হ্যাঁ, যদি সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্য ইবাদত করে ও কুরবানীর ইচ্ছা রাখে।
২. গরীব ব্যক্তি কি ঈদের দিনে রোযা রাখতে পারে কুরবানীর বদলে?
রোযা রাখা সওয়াবের কাজ, তবে তা কুরবানীর পরিবর্তে নয়; বরং আলাদা ফজিলতের ইবাদত।
৩. মৃত বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে কুরবানী দিলে তাঁরা কি সাওয়াব পাবেন?
হ্যাঁ, ইনশাআল্লাহ। যদি তারা জীবিত থাকতে কুরবানী করতেন বা নিয়ত রাখতেন।
৪. দান করলে কি কুরবানীর সমান সাওয়াব পাওয়া যায়?
সাওয়াব হতে পারে, কিন্তু কুরবানী একটি আলাদা ইবাদত, যার বিকল্প নেই।
৫. ছাত্র বা চাকরিজীবী যার কোনো আয় নেই, তার কি কুরবানী করা জরুরি?
না, কুরবানী ওয়াজিব নয়; তবে ইচ্ছা রাখলে আল্লাহ তা কদরে নেবেন।